।। ১ ।।
পুরনো ছবিগুলো কদাচিৎ নেড়েচেড়ে দেখা হয়। যতটা না পুরনো সময়ে ফিরে যাওয়ার অভিপ্রায়ে, তার চেয়ে বেশি নিজের মুখায়বের বিবর্তন যাচাই করতে। এবং বরাবরের মত হাসি পায় পুরনো মুখায়ব দেখে। তার পাশে বর্তমান মুখায়বকে দাঁড় করিয়ে এক হাস্যকর তুলনা করে নিজেই হাসি।
একপাশে পুরনো সময়ে তোলা ছবি, অন্যপাশে সাম্প্রতিক সময়ের ছবি। পার্থক্য করতে শুরু করি। পুরনো ছবিতে আমার বয়স ১১, এবং এখন (লেখাকালীন) ১৯। আট বছর পেরিয়ে গেছে, আমার ছোট্ট মামাত ভাইয়ের চেয়েও বয়েসের দিক থেকে এই ছবিটি জ্যেষ্ঠ।
পার্থক্য দেখতে পাই। চেহারা আরো কালো হয়েছে, শরীর বেড়েছে, কৈশোর ছেড়ে যৌবনে পা রেখেছি, পাতলা ঠোঁটের উপরের মসৃণ অংশে গোঁফের রেখা জন্মেছে, কানের পাশের মসৃণতার স্থলে দাড়ির আনাগোনা দেখা যাচ্ছে; এবং সবচেয়ে বড় কথা, পুরো চেহারাটাই বেশ বদলে গেছে।
একটি ছবি শুধু বাহ্যিক রূপ ধারণ করতে পারে, আভ্যন্তরীণ রূপ নয়। এই আট বছরে আমার ভেতরে কেমন পরিবর্তন হয়েছে, তা ছবি দেখে বুঝা যাবে না। তা বুঝা কখনও সম্ভবও নয়।
।। ২ ।।
শৈশবে সকলেই চাইত, তারা যেন দ্রুত বড় হয়ে যায়। 
বড় হয়ে গেলে আর মায়ের কড়া নির্দেশ মান্য করে দুপুরবেলার বিরক্তিকর ঘুমের কাছে হার মানা লাগবে না।
বড় হয়ে গেলে স্কুলে যাওয়া লাগবে না।
বড় হয়ে গেলে হোম টিউটরের কাছে পড়া লাগবে না, মারও খাওয়া লাগবে না।
বড় হয়ে গেলে যখন ইচ্ছে তখন গল্পের বই পড়া যাবে।
বড় হয়ে গেলে যখন ইচ্ছে তখন টিভিতে কার্টুন দেখা যাবে।
বড় হয়ে গেলে আর মায়ের কড়া নির্দেশ মান্য করে দুপুরবেলার বিরক্তিকর ঘুমের কাছে হার মানা লাগবে না।
বড় হয়ে গেলে স্কুলে যাওয়া লাগবে না।
বড় হয়ে গেলে হোম টিউটরের কাছে পড়া লাগবে না, মারও খাওয়া লাগবে না।
বড় হয়ে গেলে যখন ইচ্ছে তখন গল্পের বই পড়া যাবে।
বড় হয়ে গেলে যখন ইচ্ছে তখন টিভিতে কার্টুন দেখা যাবে।
এরকম অসংখ্য অতৃপ্ত বাসনার সম্ভাব্য বাস্তবায়ন হবে 'বড় হয়ে গেলে'- এমন ধারণা নিয়েই সকলে প্রতীক্ষায় ছিল বড় হওয়ার।
যখন বড় হলো, ঘাড়ের রগ শক্ত হলো, হাতের পেশি অনেকটা দৃঢ় হলো, মুখের কোমল ভাব ছাপিয়ে কাঠিন্যভাব এসে হাজির হলো, ঠোঁটযুগলের উপরে গোঁফের রেখা জন্মাতে শুরু করলো, স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজের প্রাঙ্গণে প্রবেশ করা হলো, এবং কয়েকটা মাস স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগ করতে করতে সকলে অভ্যস্ত হয়ে পড়ল; ঠিক সেই সময়েই অযাচিতভাবে তার ভেতর থেকে একটি কথাই বেরিয়ে আসে। সেই কথাটি হলো, "ছোট ছিলাম, ভালোই তো ছিলাম।" ছোট্ট একটা কথা। অথচ সেটি কতই না বেদনা বয়ে বেড়াচ্ছে। ছোট্ট কথাটি সকলেরই, অথচ সে কি না বহুদিন ধরেই বড় হওয়ার ইচ্ছে মনে লালন করে এসেছিল। শেষ মুহূর্তে এসে সে কেন ঘুরে গেল, এবং তার কথাটির মর্ম কী, এতকিছু ভেবে দেখার প্রয়োজন সে মনে করে না।
তবে কথাটির মর্ম ভেবে দেখার প্রয়োজন সে মনে না করলেও এর যে কোনো মর্মার্থ নেই, তা নয়। সে এম্নিএম্নিই একথা ভাবেনি। এর পেছনে বেশকিছু যৌক্তিক কারণ রয়েছে।
ছোটবেলার সেই অপরিপক্ব মস্তিষ্ক যে জানত না,  বড় হলে কেমন সময়ের মাঝে দিয়ে যেতে হয়। 'সময়' ব্যাপারটিকে তখন একটি মস্ত বড় অজগরের ন্যায় মনে হয়, যে অজগর ধীরে ধীরে গিলে নেয় সকলের বিষাদময় মনকে। শুধু বিষাদময়ই নয়, সাথে এমন মন, যে ক্লান্ত। যার প্রয়োজন পূর্ণ  বিশ্রাম। তবে অজগর ক্লান্ত-চঞ্চল-বিষণ্ণ, কাউকেই যে রেহাই দেয় না!
ছোটবেলার সেই সরল মস্তিষ্ক যে জানত না, বড়দের কত কষ্ট করে জীবন নামক তরীর উপর দিয়ে ভেসে যেতে হয়। এই তরী অনেকক্ষেত্রে তীরেই নিমজ্জিত হয়।  জীবনের জটিলতা এই তরীডুবির প্রধান আসামী। তবে শুধু তরী ডুবিয়েই তা ক্ষান্ত হয় না, বরং তাদেরকে আঁকড়ে ধরে আমাজন বনের সেই শিকারী মাকড়সার মত। এবং সেই আঁকড়ে ধরার প্রক্রিয়াটিও খুবই জটিল এবং এর সাথে যন্ত্রণাদায়ক । তা থেকে বেরোনোও খুব কষ্টকর, এবং কিছুটা অসম্ভবও।
ছোটবেলার সেই শান্ত, ধীরস্থির, জঞ্জালমুক্ত, পঙ্কিলতামুক্ত মস্তিষ্ক যে জানত না, বড় হলে তার পরিচিত জীবনধারা কেমন হিংস্র, ক্ষিপ্র হয়ে ওঠে; এবং সে তার হিংস্রতার ছোবলে  সকলের মনকে কেমন জঞ্জাল ও পঙ্কিলময় করে তোলে। সেই ছোবলের বিষক্রিয়ায় সকলের ভেতর ও বাহির তখন কীভাবে যে জ্বলতে থাকে, পুড়তে থাকে, ধ্বংস হতে থাকে,  এসব কথা ছোটরা জানবে কীভাবে!
এতসব জটিলতার মাঝে পড়ে গিয়েই বড়গণ প্রকাশ্যে বলতে বাধ্য হন, "ছোট ছিলাম, ভালোই তো ছিলাম।" তবে যে কথাটি অপ্রকাশ্য থাকে, সেটি জানার জন্যেই বোধহয় ছোটরা বড় হতে চায়। তাদের কৌতূহল বড়ই অদ্ভুত।
।। পরিশিষ্ট ।।
পুরনো ছবিগুলো ফটো অ্যালবামে রেখে দেয়ার পূর্বে আরেকবার দেখে নিলাম। কী নিষ্পাপ, কী নিস্পৃহ, কী চিন্তামুক্ত চোখযুগল! সেই মুখের দিকে তাকালে মনে হয়, কেমন স্নিগ্ধতাভরা সেই মুখগুলো। সেই হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে শুধু চেয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়। সেই চেহারায় নেই কোনো ক্লেশ, কোনো দুশ্চিন্তা, কোনো পাপবোধ, এবং কারো  অভিশাপ।
অথচ এখন সেসব বয়ে চলছি, একরাশ হতাশা আর গ্লানি নিয়ে। বোঝাটা খুব ভারী। নামাতে পারছি না, পুণরায় তুলে নেয়ার ভয়ে।
মাঝেমাঝে মনে হয়, আবার যদি ছোটবেলায় ফিরে যেতাম! সেই শীতল ও জটিলতাহীন  মুহূর্তগুলোয়, সেই সুনিবিড় ছায়াময় ক্ষণগুলোয়, সেই মধুময় স্মৃতিবিজড়িত দিনগুলোয় ফিরতে যে ইচ্ছে করে...।
 
 
Post a Comment