বলপয়েন্ট কলমের পাদদেশ কামড়ে রেখে এক অহেতুক চিন্তায় নিমগ্ন হয়ে আছে ঊনিশ বছর বয়েসী রাজু। রুমের দেয়ালের এক কোণায় ঘাপটি মেরে বসে থাকা টিকটিকির দিকে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ। টিকটিকিটি তার সামনে বসে থাকা এক অদ্ভুত পোকাকে শিকারে পরিণত করার অপেক্ষায় দীর্ঘক্ষণ ধরে প্রতীক্ষমাণ। রাজুও কি অপেক্ষায় আছে টিকটিকির শিকারের? ঠিক তা নয়। সে আসলে অন্য চিন্তায় নিমগ্ন, টিকটিকির শিকারসংক্রান্ত চিন্তায় নয়। টিকটিকির স্থলে মাকড়সা থাকলেও সে তাকিয়ে থাকত, তেলাপোকা থাকলেও সে তাকিয়ে থাকত। আবার কিছু না থাকলেও তার শূন্যদৃষ্টি ফিরে আসত না।

রাজু কোনো চিত্রকর নয়। নইলে সে মুহূর্তের মাঝেই এই টিকটিকিটিকে এঁকে ফেলত। তবে প্রাণীর ছবি আঁকার অধিকার পাওয়ার আগে তাতে প্রাণ যুক্ত করার অধিকার থাকা উচিত। সেই অধিকার তার নেই। অধিকার কি, ক্ষমতাই তো নেই। এবং এ ব্যাপারটা শুধু তার ক্ষেত্রেই নয়, পাবলো পিকাসোদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

বাম হাতের বুড়ো আঙ্গুল বাদে বাকিগুলো ব্যস্ত হয়ে পড়ল রাজুর চুলের খুশকির যন্ত্রণা সাময়িকভাবে দূর করতে। তার সামনে রাখা খাতার সফেদ পৃষ্ঠায় এখনও কলমের একটি কালো দাগও পড়েনি। সেটিই চিন্তার বিষয়। সে খাতা নিয়ে বসে আছে, অথচ তাতে কিছু লেখা হয়নি, এরকম ঘটনা বলতে গেলে কখনোই ঘটেনি তার সাথে। আজ অনেকদিন বাদে সে লিখতে বসল, আর সে সময়টাতেই তার হাতে রাজ্যের যত প্রতিবন্ধকতা এসে জমা হতে লাগল।

রাজু গল্প লেখে। অবশ্য সে কোনো লেখক নয়। তার লেখাগুলো কখনও কোথাও ছাপেনি। স্কুল-ম্যাগাজিনে কখনও তার নামে কোনো গল্প আসেনি। কারণ, তখন রাজুর গল্প লেখার নেশা ছিল না। তখন তার নেশা ছিল ছবি আঁকার প্রতি। ক্লাসে একমাত্র সে-ই ভালো ছবি আঁকতে পারত। অবশ্য কোনো প্রতিযোগিতায় সে কখনও অংশ নেয়নি। এর পেছনে দায়ী ছিল তার অপরিসীম লজ্জা ও ভয়। ক্লাস নাইনে থাকতে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল স্কুলের ‘২১শে ফেব্রুয়ারি’ উপলক্ষে ফি বছর আয়োজিত অঙ্কন প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে। ফি বছরের মত সে বছরও সেটি অনুষ্ঠিত হবে, এমন আশাই ছিল তার মনে। তবে রাজু যেমনটি আশা করেছিল, তেমনটি শেষমেশ আর হয়নি। কী এক অদ্ভুত অনিবার্য কারণে অঙ্কন প্রতিযোগিতার সেগমেন্টটি সেবার বাদ দেয়া হয়েছিল। অনেক আশা বুকে নিয়ে রাখায় আশাহত রাজু তাই অনেক কষ্ট পেয়েছিল সেবার। তবে এখন সে ভাবে, ‘যা হয়, ভালোর জন্যেই হয়।’

রাজু গল্প লিখতে শুরু করেছে কয়েক বছর হল। কখনও কাউকে লেখাগুলো দেখায়নি। তার ছবি আঁকার নেশার ব্যাপারটি অনেকে জানলেও গল্প লেখার নেশার ব্যাপারে সে কাউকে জানায়নি। জানাবে কেন, তার লেখাগুলো যে খুব আনাড়ি মানের। লেখা পড়েই কে না কে কী ধরনের মন্তব্য করে বসে, তার ঠিক নেই। তবে তারপরেও সে নিভৃতে গল্প লিখে যায়। কারণ, সে এতে আনন্দ পায়। এবং ঠিক বর্তমান সময়ে তার বেশ আনন্দের প্রয়োজন।

তবে অন্যকে আনন্দ দিতেও তার খুব ইচ্ছে করে। গল্পগুলো জমা হয়ে আছে খাতায়।
একটার পর একটা খাতা শেষ হয়ে যায় শুধু গল্প লিখতে গিয়েই। সে হয়ত তিনটি গল্প লিখল, এর মাঝে একটি গল্প হয়ত তার বিবেচনায় চমৎকারিত্বের সাথে গ্রহণযোগ্যতা পায়। বাকি দু’টোর বিভিন্ন সমস্যা সে নিজেই বের করে ফেলে। তবে তার খাতাগুলো সে সবসময় সংরক্ষণ করতে পারে না। তার এমন পাঁচটি খাতা ছিল, যেখানে ছিল শুধুই গল্প আর গল্প। কয়েকমাস আগে সেগুলোর হদিস পাওয়া যাচ্ছিল না। নিজের রুমে না পেয়ে ভাইয়ের রুমে খুঁজতে গেল সে। যদিও সে জানে, ভাইয়ের রুমে কখনোই সেগুলোর সন্ধান পাওয়া সম্ভব নয়। শেষমেশ মায়ের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, সেগুলো কাগজওয়ালার কাছে বেচে দেয়া হয়েছে। এ খবর জেনে রাজুর মনের অবস্থা যে কী হয়েছিল, তা আর নাই বলি।

এরপর থেকে রাজু তার গল্প লেখার খাতাগুলো এমন জায়গায় রাখতে শুরু করল, যেখান থেকে সে ছাড়া অন্য কেউ কখনও উঁকিও দেবে না। এমনই গোপন জায়গা সেটি।

রাজু গল্প লিখে, তবে যেনতেন গল্প নয়। সে পুতুপুতু ধরনের গল্প লেখে না। রোমান্টিক গল্প তার দু’চোখের বিষ। সে যা লেখে, সে ধরনের গল্প সে খুব কমই পড়েছে।

তার পড়ার তালিকার গল্প-উপন্যাসে এ ধরনের কোনো লেখা সে পায়নি। তার মনে হয়েছিল, এ ধরনের গল্প খুব কমই লেখা হয়েছে। আর বাংলা সাহিত্যে হয়ত এ ধরনের গল্পের কোনো ঠাঁই-ই নেই।  শিক্ষামূলক গল্প লিখতে অভ্যস্ত রাজু। তবে ঈশপ বা নাসিরুদ্দীন হোজা ধরনের গল্প নয়। হ্যাঁ, সেগুলোও শিক্ষামূলক। আনন্দের সাথে যেন শিক্ষাটাও থাকে, সে চেষ্টায় নানান গল্প লিখে যায় সে।

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় তার গল্পগুলো খুব একটা ভালো মানের হয় না। রাজু নিজেই সেগুলোর দুর্বলতা উপলব্ধি করতে পারে। অনেক গল্প সে মাথায় নিয়ে রাখে, তবে লিখতে পারে না। আবার অনেক গল্প হুট করে কোনো পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই সে হড়বড় করে লিখে ফেলে। তার বেশিরভাগ গল্পই এভাবে হড়বড় করে লেখা। 

কালেভদ্রে কবিতা লেখে রাজু। সেগুলোর কথা আর বলতে। ছন্দজ্ঞান সম্বন্ধে তার তেমন ধারণা নেই। ক্লাস নাইনে অবশ্য সনেট ছন্দ সম্বন্ধে বিন্দু সমান ধারণা পেয়েছিল। ‘কখকখ কখখক, গঘগঘগঘ। ঘঙচ ঘঙচ......” এসব হাবিজাবি, তার ভালো করে মনেও নেই।

অবশ্য কবিতাগুলো রাজু ফেসবুকে প্রকাশ করত। তার এক কবি বন্ধু আছে। আসলে সে
স্কুলবন্ধুই, পরে হয়ে গেল কবিবন্ধু, কারণ সেও কবিতা লেখে ও ভালোবাসে। রাজুর কবিতাগুলো পড়ে সে বাহ্বা দিত। নানান বিশেষণে তার কবিতাগুলোকে বিশেষায়িত করত। তবে কয়েকটি কবিতার পর তার বন্ধুর রিভিউ পালটে যেতে লাগল।

"রাজু, বাংলা ভাষার প্রতিশব্দ নিয়ে 'বাংলা একাডেমি’র একটি বই আছে, সেটা কিনে নিতে পার",
"রাজু, বাংলা একাডেমির বাংলা টু বাংলা অভিধানটি কিনে নিও",
"রাজু, তোমার এ কবিতার দ্বিতীয় স্তবকের সাথে চতুর্থ স্তবকের ছন্দ মিলেনি। তাল-বেতাল হয়ে গেছে। সতর্ক হও",
"রাজু, আমার মনে হয় তুমি রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, এঁদের কবিতা একটাও পড়নি।"
রাজুর বন্ধুটির সর্বশেষ মতামতটি সত্য।
রাজু কখনও পাঠ্য ছাড়া অন্য কোনো কবিতা পড়েনি। 

কবিতা তাকে টানে না, তবে উপন্যাস তাকে টানে। তবে এখানেও সমস্যা রয়ে গেছে। সে কবিতা পড়তে পছন্দ না করলেও তা অন্তত লিখতে হলেও পারত, ছন্দ মিলুক না মিলুক। তবে উপন্যাসের ব্যাপারে সে অনেক হতাশ হয়ে পড়েছে। কারণ, তা সে কখনও লিখতে পারেনি। উপন্যাস লেখার প্রস্তুতি নিয়ে লিখতে শুরু করে ১৩-১৪ পৃষ্টায় এসে থেমে যায়। তাকে কে বলবে যে, উপন্যাস লেখা মানে আলাদা একটি জগত তৈরি করা। এটি দৈবাৎ প্রক্রিয়ায় কখনও ঘটা সম্ভব নয়। এর জন্যে প্রয়োজন অসম্ভব কল্পনা শক্তি, যদি পুরো উপন্যাসটা অসত্য ঘটনায় পরিপূর্ণ থাকে। উপন্যাসের প্রতিটা চরিত্র নিয়েও তো আলাদা চিন্তাভাবনা করা লাগে। রাজু সেগুলোর ধার কখনও ঘেঁষেনি।  তার উপন্যাসগুলো এমনভাবে আটকে যায়, যেমন গলায় বিঁধে যায় মাছের কাঁটা। তবে মাছের কাঁটাও একসময় ছুটে যায়, তার উপন্যাস কখনও ছুটে না।

Solitude, Outdoors, Dark, Gloomy, Man, Standing

উপন্যাস লেখার পূর্ণাঙ্গ প্লট কখনও তার মাথায় আসেনি। সেগুলো আসে খণ্ড খণ্ড আকারে। তাও সেগুলোর মধ্যে নেই কোনো ধারাবাহিকতা। আজ হয়ত সে ভাবলো কোনো বেকার যুবকের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে উপন্যাস লিখবে, কিন্তু কালই তা বদলে গিয়ে চলে আসে এক আধাবুড়ো লজিং মাস্টারের ঘটনাপ্রবাহ। আবার এর কয়েকদিন বাদে এক ষোড়শী কিশোরী চরিত্রও তার সামনে চলে আসে কিছু অপূর্ণাঙ্গ ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে।

গল্প-উপন্যাস লিখতে হলে তো সাহিত্য বুঝা লাগে। রাজুর সে বুঝ নেই। ‘ঘুমের ঔষধের বিকল্প হল সাহিত্য’ -এটাই হলো রাজুর কাছে সাহিত্যের সংজ্ঞা। রাজুর গল্পে তাই 'ঘুমের ঔষধের বিকল্পের' কোনো ছিটেফোঁটা নেই।

যাক এত কথা। রাজুর চিন্তায় ফিরে আসা যাক। সে এখনও ভাবছে। মানসম্পন্ন সাহিত্য তার সামর্থ্যের বাইরে। প্রকৃত সাহিত্য সে হয়ত লিখবে না। তবে রাজু এখন কী লিখবে! সে দ্বিধান্বিত। গত তিন-চার মাস পূর্বে সে সর্বশেষ গল্প লিখেছিল। আগে প্রতিমাসে সে ৩-৪টি গল্প লিখে ফেলত। গল্প লেখার ব্যাপারটি অনেকটা নেশার মত, একটির পর একটি গল্প শুধু লিখে যেতেই ইচ্ছা করে। তবুও তৃপ্তি মেলে না।  রাজু এখনও ভেবে পাচ্ছে না কী নিয়ে গল্প লেখা যায়। আশেপাশের ঘটনাগুলো নিয়ে কি লেখা যায়?

পাড়ায় একটা কুকুর ছিল, সবাই ডাকত ‘জিমি’। রাজু ক্লাস সিক্স থেকে তাকে দেখে আসছে। তখনও কুকুরটি বেশ বড়সড়ই ছিল। কুকুরটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল, তার ভাঙা দু’কান। অন্য কুকুরের মত খাড়া খাড়া কান নয়। তাই অনেক দূর থেকেও তাকে চেনা যেত। ঝুলে থাকা কানের কারণে তাকে বেশ নিরীহ এবং অনুগত দেখাত। এলাকার অন্যান্য কুকুরগুলো শীর্ণকায় হলেও ‘জিমি’ বেশ স্বাস্থ্যবান ছিল। সে কারো ব্যক্তিগত পোষ্য ছিল কিনা, তা রাজুর জানা নেই। সেই ক্লাস সিক্স থেকেই তাকে বেওয়ারিশ কুকুরদের সাথেই উঠাবসা করতে দেখছে সে। প্রায় আট বছর ধরে তার রাজত্ব ছিল এ এলাকার কুকুরসমাজের উপর।

তবে তার শরীর দুর্বল হয়ে আসল একসময়। চেহারায় বার্ধক্য দেখা দিল। আগের দুরন্তভাব একেবারেই মিইয়ে গেল। একা একা থাকতে শুরু করল সে।

এলাকায় কয়েকদিনের জন্যে কোত্থেকে এক বানর এসে হাজির হলো। সম্ভবত দূরবর্তী বন থেকেই সে লাফিয়ে লাফিয়ে এলাকায় এসেছিল। মানুষকে বিরক্ত করতে শুরু করল সেটি। বানরটিও মোটামুটি বয়স্ক ছিল। জিমি’র সাথে তার বনিবনা হত না। প্রায়শই গাছে বসে থাকা সেই বহিরাগত বানরকে দেখে নিচ থেকে জিমি ঘেউঘেউ করত। 
একদিন হঠাৎ জিমিকে সেই বানর আক্রমণ করে বসল। জিমির উপরের অংশ অর্থাৎ পিঠে কামড়ে এক খাবলা মাংস ছিঁড়ে নেয় সেই বানরটি। অবশ্য এটি শোনা কথা, রাজু সরাসরি দেখেনি। যারা বলেছে, তারাও ধারণা করেছে মাত্র। তবে জিমির পিঠের ক্ষতস্থান দেখে সে ঘটনাকে অস্বীকারও করা যায় না।

আগে থেকেই কিছুটা অসুস্থ জিমি এবার আরো অসুস্থ হয়ে পড়ল। অনেকে বলাবলি করতে লাগল যে বানরের কামড়ের বিষ কখনও ছাড়ে না, তাই জিমির আর রক্ষা নেই। জিমি হয়ত আরো বেশ কয়েকদিন মোটামুটি বেঁচে থাকত।

তবে এলাকার দুষ্ট ছেলেরা প্রায়শই তার সেই ক্ষতস্থানে দূর থেকে প্রকাণ্ড ইট ছুঁড়তে লাগল, এতে নাকি তারা আনন্দ পেত। রাজু ভেবে পায়নি এটি কোন জগতের আনন্দ।

বানরের কামড়ের ফলেই, নাকি সেই দুষ্ট ছেলেদের হৃদয়হীনতার ফলে, তা রাজু জানে না; তবে এক বিকেলবেলায় জিমি রাজুদের বাসার আঙিনায় এসে তার অসুস্থ শরীরটিকে সেই যে ফেলল, আর উঠালো না।
রাজু নিজের চোখের সামনেই তার মৃত্যু দেখেছে। যখন সে নিজের শরীরটুকু ফেলে দিয়েছিল, তখন রাজুর মা তাকে বললেন যে একে ভাগিয়ে দিতে। রাজু মুখে শব্দ করলে জিমি তার চোখের পাতা সামান্য নাড়াল। রাজু দ্বিতীয়বার শব্দ করলে জিমি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। রাজুর বাবা পাশের বস্তি থেকে তিন-চারটা ছেলে ধরে এনে তাদের দায়িত্ব দিল, যেন তারা জিমির মৃতদেহটি দূরে কোথাও ফেলে দিয়ে আসে। এর বিনিময়ে তারা বিশটি টাকা পেয়েছিল। মৃত জিমির গলায় রশি বেঁধে তাকে টেনে টেনে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটি এখনও রাজুর মনে আছে। সমস্ত ঘটনাটিই তার মনে দাগ ফেলে। জিমিকে নিয়ে কি সে কোনো গল্প লিখবে?

জিমির সাথে রাজুর প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিল না। যেমনটি ছিল ‘মিনি’র সাথে। ক্লাস টেনে পড়াকালীন রাজুর একটি পোষা বিড়াল ছিল। মেয়ে বিড়াল বলেই সে তার নাম রেখেছিল ‘মিনি’। রাজুর সাথে মিনির ছিল খুব গলায় গলায় ভাব। বিড়ালটিকে বাইরে কোথাও যেতে দেয়া হত না। তবে একদিন হঠাৎ সেটি কীভাবে যেন গর্ভবতী হয়ে পড়ল। রাজুর মা গেলেন চটে। তিনি একটি বিড়ালকেই সহ্য করতে পারতেন না, এখন আরো আপদ আসবে- এ ব্যাপারটি তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না।

তারপরও রাজুর শখের উপর তিনি হস্তক্ষেপ করলেন না। গর্ভবতী হওয়ার পূর্বে রাজু মিনিকে নিজের কোলে নিয়ে ঘুমাত। অথবা রাজু শুয়ে পড়লে মিনি নিজ থেকেই রাজুর কোলে ওঠে পড়ত। গর্ভবতী হওয়ার পর মিনি নিজেকে আড়ালে রাখতে শুরু করল। রাজুর মা জানালেন, ওদের বাচ্চা হওয়ার আগে ওরা একাকী থাকতে পছন্দ করে।

কয়েকদিন বাদে সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেও মিনিকে পাওয়া গেল না। মিনির এই আকস্মিক প্রস্থানে রাজু অনেক মুষড়ে পড়ে। তার খাওয়াদাওয়া ও স্বাভাবিক কাজে- কর্মে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। রাজু অনেক আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল মিনিকে নিয়ে গল্প লিখবে। নামও নির্ধারিত, ‘মনে মিনি’। বাস্তব ঘটনার সাথে রাজুর বেদনার অভিজ্ঞতা মিশিয়ে তৈরি হবে একটি চমৎকার ট্র্যাজেডি গল্প। পাঠকও লেখকের ব্যথায় হবে সমব্যথিত।

না, থাকুক। মিনমিন ধরনের ট্র্যাজেডি গল্পের পরিকল্পনা বাদ। বিড়াল পালিয়ে গেছে, এতে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদবে তো মেয়েরা, ছেলেরা নয়। গল্পটাও মেয়েলি ধাঁচের হয়ে যেতে পারে।

রাজুর বড় ভাই রাকিবের এক বন্ধু একবার গাজীপুরের এক শ্মশানে গিয়ে নাকি ভূত দেখেছিল। নাহ, ভূত-প্রেত, সেসব হাস্যকর।
রাজু আর যা-ই লিখুক, ভূতের গল্প কখনও লিখবে না। তাছাড়া ভূতের গল্পও তাকে কবিতার বইয়ের মত বিকর্ষণ করে।

রাজুর মস্তিষ্ক হঠাৎ শূন্য হয়ে গেল। স্মৃতির সাহায্য ছাড়া সে তো কিছুই লিখতে পারে না। স্মৃতির কাছেই শরণ নিতে হয় তাকে বারবার। তার কল্পনাশক্তি বলে কি তাহলে কিছুই নেই। সে যাই লিখতে যাচ্ছে, সবই তার স্মৃতির ডায়েরির পাতা থেকে। লেখক হতে গেলে তো অসম্ভব কল্পনা শক্তির অধিকারী হতে হয়। রাজুর লেখক হওয়ার বাসনা কি তাহলে অধরাই রয়ে যাবে।

রাজু পুণরায় দেয়ালের কোণায় তাকাল। টিকটিকিটি একটু জায়গা পরিবর্তন করে সামনে এগিয়েছে। তার সামনের সেই অদ্ভুত পোকাটি আর নেই। হয় সেটি উড়ে গেছে, অথবা টিকটিকি সেটিকে সাবাড় করে ফেলেছে।

রাজু এবার সাহস করে কল্পনার আশ্রয় নিতে লাগল। স্মৃতির আশ্রয় সে নিতেই চাচ্ছে না। এর পেছনে একটি নির্দিষ্ট কারণ অবশ্যই আছে।  রাজুর কল্পনা তাকে তেমন প্রশ্রয় দিল না। যেন দূর, দূর করে তাকে তাড়িয়ে দিল। তার কল্পনার ঝুলি শূন্য, এর তুলনায় স্মৃতির ঝুলি পরিপূর্ণ। তবুও মস্তিষ্কে সে চাপ দিতেই লাগল কল্পনাশক্তিকে আরো প্রবল করে তোলার জন্য। সে জানে, এ চেষ্টা ব্যর্থ চেষ্টা। জোর করে কিছু করা যায় না। সে ভেতরে ভেতরে অস্থিরতা অনুভব করতে লাগল।

মকবুল চাচা রাজুর ঘরে ঢুকলেন,
-রাজু মামা, চলেন, আম্মা ডাকতেছে। খাবার দেয়া হইছে।
খাতা বন্ধ করে রাজু সেটি টেবিলের এক কোণায় রেখে দিল। কলমটির মুখ বন্ধ করে একপাশে ছেড়ে দিল সেটি। মকবুল চাচা ঠেলতে লাগলেন। খাবার টেবিলের সামনে না আসা পর্যন্ত তিনি থামলেন না।

রাজুর মা তাকে খাবার পরিবেশন করতে লাগলেন। খেতে খেতেই রাজুর বাবা বললেন,
“রাজু, তোমার রুমে কিন্তু আলাদা খাবার পাঠিয়ে দেয়া যেত। তবে সবাই মিলে একত্রে খাওয়ার মধ্যে একটা আলাদা আনন্দ আছে। সেটা তুমি হয়ত বুঝো।”
রাজু জবাব না দিয়ে চুপচাপ খেতে লাগল।
রাজুর বাবা বলতে লাগলেন,
“ডাক্তার আলতাফের সাথে কথা বলেছি। উনি এসে তোমাকে চেকাপ করবেন। তৈরি থেকো ।” রাজুর মা বললেন,
“আমার রাজু এবার পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠবে ।” রাজু মায়ের কথা শুনে বাইরে লজ্জার হাসি হাসল। ভেতরে হাসল অন্য হাসি। সে জানে, তাকে মিথ্যে সান্ত্বনা দেয়া হচ্ছে।

যখন রাজুর কোনোই কাজ থাকে না, তখন হয় সে গল্প লেখে, অথবা নিজের স্মৃতির ডায়েরির পাতা উল্টাতে থাকে। স্মৃতির ডায়েরি থেকে ভেসে আসতে থাকতে জিমি, মিনি, নানাজান, দাদীজান, ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দেয়া সেই অচেনা মানুষটির দেহের খণ্ড খণ্ড টুকরো, পিটিয়ে মেরে ফেলা সেই ছিঁচকে চোরের নিথর দেহ, ইত্যাদি। সবই মৃত চরিত্রের দুঃসহ স্মৃতি।

সুখস্মৃতিও আছে। ক্লাস ফাইভে ‘আমার পণ’ কবিতা আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় তার ৫ম স্থান অধিকার, সপরিবারে কক্সবাজার বেড়াতে যাওয়া, প্রথম মৌলিক কবিতা-গল্প লেখা, স্কুলের ফেয়ারওয়েলে সকল বন্ধু ও শিক্ষকদের ভালোবাসায় সিক্ত হওয়া।

স্মৃতির ডায়েরির সর্বশেষ ঘটনায় যখন সে এসে পড়ে, তখন তার অনুভূতিগুলো চঞ্চল হয়ে ওঠে। সেই ঘটনার উপকরণগুলো তাকে তাড়িয়ে বেড়ায় স্বপ্নের মধ্যেও। স্বপ্ন ও বাস্তবে কিছুটা পার্থক্য আছে। তবে সেটি রাজুর মধ্যে যে অনুভবের সৃষ্টি করে, তাতে পার্থক্য নেই।

এক লরি এসে রাজুর ওপর দিয়ে চলে গিয়েছিল। বিভীষিকাময় যন্ত্রণায় সে চিৎকার করতেও ভুলে গিয়েছিল। জ্ঞান হারিয়ে সে পথে পড়েছিল খানিকক্ষণ। যখন তার জ্ঞান ফেরে, তখন সে হাসপাতালে।
ঠিক তখনই তার খেয়ালে এল, সে তার দুই হাঁটুর নিচের অংশটি আর অনুভব করতে পারছে না। প্রায় দু’মাস এভাবে হাসপাতালে পড়ে ছিল সে। বাড়ি ফিরেও পড়ে ছিল আরো দেড় মাস। হুইল চেয়ারেই তার জীবন সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ল। এবং সে হয়ে পড়ল এক ‘অর্ধমানব’।

স্মৃতির এ অংশটি রাজুর মনে এলেই সে এক গাঢ় অস্থিরতা অনুভব করে। রুমের মাঝের খালি অংশে হুইল চেয়ার ঘুরাতে ঘুরাতে নিজের অস্থিরতা রুমের মধ্যে ছড়িয়ে দেয় সে। তবুও অস্থিরতা কমে না। এ অদ্ভুত অনুভবের মধ্যে দিয়ে সে আর কতদিন যাবে, তা সে জানে না। তবে সে জানতে চায়। কিন্তু তাকে কে জানাবে!

রাজুর মাঝেমধ্যে খুব কাঁদতে ইচ্ছে করে। যেমনটি এখন করছে।
“মকবুল চাচা, আমার জন্যে পানি রেডি করেন।"
সে আজ কাঁদবে, অন্ধকার কক্ষের মাঝে হুইল চেয়ারে বসে কাঁদবে। যেই মহান সত্তা তার হাঁটার শক্তি কেড়ে নিয়ে তাকে পরীক্ষার মধ্যে ফেলেছেন, তার প্রশংসার পরেই তার সামনেই সে কাঁদবে। সে তাঁর কাছে চাইবেও। তিনি যেন তার হাঁটার শক্তি ফিরিয়ে দিন, এটি নয়; বরং এর বিনিময়ে যেন সে এবং তার বাবা-মা খুব ঈর্ষাত্মক পুরষ্কারে পুরস্কৃত হয়, সেটাই।

রাত নেমে গেল, রাজুর অশ্রুর সাথে তাল মিলিয়েই।

Post a Comment

Previous Post Next Post