ত্বালহা চুপচাপ তার পড়ার টেবিলের সামনে চেয়ারে বসে আছে। তার বইপত্র খোলা 
কিন্তু সে পড়ছে না। তার মনোযোগ যে পড়ার মধ্যে নেই এটি তাকে দেখেই বোঝা 
যাচ্ছে।
তার বাবাও এটি বুঝতে পারলেন। কাছে এসে বললেন,
-কী ত্বালহা মিয়াঁ, পড়ছো না কেন?
ত্বালহা বাবার দিকে বিরক্তমুখে তাকিয়ে বলল,
-বাবা আমাকে ‘মিয়াঁ, মিয়াঁ’ বলে ডেকো না তো। খুব রাগ লাগে!
বাবা হেসে দিলেন। পাশের চেয়ার টেনে তার পাশে বসতে বসতে বললেন,
-আচ্ছা ঠিক আছে আর ‘মিয়াঁ’ ডাকবো না। এখন বল পড়ছো না কেন? পড়তে ইচ্ছা করছে না?
- না!
- না? কেন?
- আমার মন খারাপ!
- মন খারাপ কেন? 
- আম্মু বকেছে?
- বল কী!  কীজন্যে? 
- আমি আজ ক্লাস টেস্টে কম নাম্বার পেয়েছি এজন্যে।
- হুম। তোমার আম্মুর এটা করা একদম উচিত হয়নি।
- আমিও এটাই বলছিলাম। আমি গত টেস্টে তো ফার্স্ট হয়েছি। এবার একটু খারাপ করলাম। এতেই আম্মু এত বকা দিল।
- আচ্ছা, তোমার আম্মু কীভাবে তোমাকে বকা দিয়েছে। একটা অ্যাক্সাম্পল দেখাও তো।
এ বলে বাবা ঠোঁট টিপে হাসতে লাগলেন।
ত্বালহা কাঁদো কাঁদো গলায় জবাব দিল,
- আব্বু, তুমিও না ভারী ইয়ে! আমার সাথে এখন দুষ্টুমি কোরো না তো! 
- আচ্ছা ঠিক আছে বাবা। যাও, আর দুষ্টুমি করব না।
এ সময় ত্বালহার মা রুমে ঢুকে তার টেবিলে এক গ্লাস দুধ রাখলেন। বললেন,
- তাড়াতাড়ি খেয়ে নে! দশটার দিকেই ঘুমুতে হবে।
এ বলে চলে গেলেন। ত্বালহা বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
- দেখেছ আব্বু,  আম্মুর কী তেজ! 
- এতে তেজের কী হলো রে ত্বালহা? দুধ তো খাওয়ার জন্যেই।
- সেটা না তো। আম্মু আমাকে ‘তুই, তুই’ করছে!
- তো? 
- আম্মু আমাকে এম্নিতে ‘তুমি’ করে বলে। আজ রেগে আছে বলেই ‘তুই’ করে বলছে।
- আহহা রে! তুমি তোমার আম্মুর ছেলে না,  তোমাকে তুই ডাকবে না তো কি তোমার বন্ধুকে ডাকবে নাকি? আমার মাও তো আমাকে তুই ডাকত!

ত্বালহা কিছু না বলে তার অঙ্ক খাতার কভারে পেন্সিল দিয়ে আঁকিবুঁকি করতে লাগল।
বাবা বললেন,
- তোমার আম্মু তোমাকে ‘তুই’ ডাকুক বা ‘তুমি’ ডাকুক, সে কিন্তু তোমাকে ভালোবাসে।
- তুমি একথা কেন ভাবছ আব্বু?
- তোমার আম্মু তোমার জন্যে অনেক ভালো ভালো খাবার রান্না করে। তোমার প্রিয় 
কার্টুনের সিডি কিনে দেয়। আবার তুমি সাদা দুধ পছন্দ করো না কিন্তু চকোলেট 
দুধ পছন্দ করো। এজন্যেই তো এখন চকোলেট দুধ আনল তোমার জন্যে।
ত্বালহা বিরক্তমুখে বলল,
- এটাতে ভালোবাসার কী হলো আব্বু? সবার আম্মু-ই তো এমন করে। এটা তো স্পেশাল কিছু না। তাই না আব্বু?
ত্বালহার বাবা একটি ছোট নিঃশ্বাস ফেলে উঠে চলে গেলেন। ‘ভালোবাসা’ ব্যাপারটি
 কেমন এটাই ত্বালহা জানে না,  তাকে তাই কিছু বুঝানোটা নিরর্থক।
ত্বালহা দুধ না খেয়ে গ্লাসের দিকে তাকিয়ে আছে। দুধের রঙ দেখছে। বাদামি 
রঙ। তার প্রিয় দুধ। কিন্তু কেন যেন এখনই খেতে মন চাচ্ছে না।তরল দুধের দিকে 
সে একমনে তাকিয়েই আছে।
হঠাৎ সে খেয়াল করল গ্লাসের দুধগুলো কাঁপছে। আস্তে আস্তে কাঁপুনি বাড়তে লাগল।
তখনই তার মা ছুটে এসে তাকে কোলে তুলে নিয়ে দ্রুত দরজার দিকে ছুটছে। ত্বালহা তো হতভম্ব! ব্যাপার কী!
তার মা দরজা খুললে সে দেখতে পেল পাশের ফ্ল্যাটের অনেক আঙ্কেল-আন্টিরাও বের হয়ে গেছে তাদের বাচ্চাদের নিয়ে। ত্বালহার ভয় ভয় করতে লাগল।
তার মা তাকে নিজের কোলে উড়না দিয়ে আড়াল করে রেখেছে। কিছুক্ষণ পর সে দেখল
 পাশের ফ্ল্যাটের নীলু আন্টি কান্ননাকাটি শুরু করে দিলেন। তাঁর কান্না দেখে
 উনার ছোট ছেলেটাও কাঁদতে লাগল।
কিছুক্ষণ পর ত্বালহার মা নিজেও কাঁদতে লাগল। মায়ের কান্না আগে ত্বালহা কখনও দেখেনি। আজই প্রথম। তারও কান্না পেতে লাগল।
কিছুক্ষণ পর ত্বালহার বাবা ঘর থেকে বের হলেন। তাঁর মুখ স্বাভাবিক, যেন কিছুই হয়নি।
তিনি সামনে এসে বললেন,
- আপনারা ভয় পাচ্ছেন কেন?
নীলু আন্টির স্বামী তাঁকে বললেন,
- বলেন কী ইসমাইল সাহেব!  আমরা ভয় পাব না!  ভূমিকম্প হলে ভয় পাব না!
- ভূমিকম্প আবার কখন হলো?!
- বলেন কী! একটু আগে পুরো বিল্ডিং যে কেঁপেকেঁপে উঠল,  এটা কি খেয়াল করেননি! নাকি ঘুমাচ্ছিলেন!
ত্বালহার বাবা হাসতে হাসতে বললেন,
- অও আচ্ছা, সেটা!  ওটা তো ভাই ভূমিকম্পের জন্যে না।
- তাহলে কীসের জন্যে?
- আমাদের এলাকাতে একটা কনস্ট্রাকশনের কাজ শুরু হয়েছে আজ থেকে। ওখানেই ভারী 
ভারী নির্মাণসামগ্রী আনা হয়েছে। সেগুলো যখন সচল থাকে ও ব্যবহার করা হয়, তখন
 এর আশেপাশের বিল্ডিংগুলো কাঁপতে থাকে। এটাই ভাই, আর কোনো কিছু না।
ত্বালহার বাবার উত্তর পেয়ে অনেকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন যেন। যার যার ঘরে সবাই চলে গেলেন।
ত্বালহাকে তার মা কোলে করে সে অবস্থাতেই বাসায় নিয়ে এলেন এবং তার বিছানায় শুইয়ে দিলেন।
- ত্বালহা,  আব্বু, ঘুমাও তুমি। আজ আর পড়তে হবে না।
এ বলে উড়নার আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে তিনি অন্য ঘরে চলে গেলেন।
এর ঠিক পাঁচ মিনিট পর তার বাবা তার রুমে ঢুকলেন। ত্বালহার দিকে তাকিয়ে সামান্য হাসিহাসি মুখ করে রইলেন।
ত্বালহা বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
- হাসো কেন আব্বু?
- কেন হাসছি বুঝতে পারছ না?
কিছুক্ষণ চুপ থেকে ত্বালহা জবাব দিল,
- পারছি বাবা।
 এ বলে গ্লাসের দুধ এক চুমুকেই সে খেয়ে নিল। দুধ খাওয়ার সময় সে মাথা উঁচু 
করেছিল। আর ঠিক তখন তার বাবা তার চোখে কোনো একটা তরল পদার্থের ঝিলিক দেখতে 
পেলেন, যা চোখ থেকে প্রায় গড়িয়ে পড়ছিল।
ত্বালহার বাবা ইসমাইল সাহেব বুঝলেন, আল্লাহ তা’আলা প্রত্যেক মায়ের 
মধ্যে  সন্তানের ভালবাসা প্রবেশ করিয়ে দিয়েছেন, যা বাবাদের চেয়ে অনেক বেশি।
 তাই তো আজ তাঁর স্ত্রী ভূমিকম্পের আতঙ্কে ছেলেকে সঙ্গে করে নিয়েই বাইরে 
ছুটে গেলেন।
আমরা সকলেই মুখে বলি ‘আমি মাকে ভালবাসি’, কিন্তু কাজে প্রমাণ করি না। 
তাই মাঝেমাঝে আল্লাহ তা’আলা বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে আমাদের এ সত্যটি বুঝিয়ে 
দেন, যা এবার ত্বালহাকে বুঝালেন।
Post a Comment