লেখকের জন্ম এই বাংলার বরিশালে। নিজেকে আজীবন সেই 'বাঙাল' মনে করেই গিয়েছেন। সে থেকেই এ বইয়ের নাম 'বাঙালনামা'। দেশবিভাগ নিয়ে খুবই তিক্ত স্মৃতি ফুটিয়ে তুলেছেন বইয়ের কয়েকটি অধ্যায়ে। দেশভাগের ব্যাপারটি পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন একেবারে ভিন্ন একটি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, গতানুগতিক সাহিত্যিকদের চেয়ে আলাদা ও স্বকীয় করে!
ভারতের শিক্ষাব্যবস্থার সূক্ষ্ম সব অসংগতি বর্ণনা করেছেন, যা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রেও বেশ ভয়াবহভাবে সত্য। এ অঞ্চলের মানুষদের (বিশেষ করে বাঙালিদের) চিন্তাভাবনা আর মনস্তত্ত্বের একটা সহজ কিন্তু ভয়ের ছবিও দেখিয়েছেন। আমাদের দেশে চলমান প্রেক্ষাপটে এসব আরও সত্য!
লেখক সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী হলেও সে ব্যাপারে অযৌক্তিক কোনো ঘৃণা এই বইয়ে একেবারেই চোখে পড়েনি। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি এবং এর পারিপার্শ্বিকতা নিয়ে বেশ প্রশংসা করেছেন। যদিও তাঁর ছাত্রাবস্থায় এবং শিক্ষকতার সময়ের মাঝেই যে পাশ্চাত্যে উচ্চশিক্ষা পদ্ধতির একটা বড় পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল, সেসব নিয়েও আছে বিশদ আলোচনা। সাথে আছে তাঁর নিজস্ব গবেষণার গল্প।
বইটা পড়তে পড়তে প্রাসঙ্গিকভাবে মনে পড়ে যাবে মিহির সেনগুপ্তের বিষাদবৃক্ষের কথা। কেননা দু'জনই বরিশাল অঞ্চলে জন্মেছেন প্রায় কাছাকাছি এলাকায় এবং দু'জন দু'টো শ্রেনীর প্রতিনিধিত্ব করেছেন। একজন জমিদার শ্রেণীর প্রতিনিধি, অন্যজন মধ্যসত্ত্বভোগী শ্রেণীর প্রতিভূ।
জমিদারী প্রথা উচ্ছেদে এই দুই শ্রেণীর আর্থসামাজিক অবস্থান কি হয়েছিল সেটাও দু'জনের লেখায় পেয়ে যাই।
দেশভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ইত্যাদি বিষয়ে গ্রামীণ চিত্র পাই মিহিরসেনের লেখায়, আর তপন রায়ের লেখায় পাই শহরের চিত্র। সামাজিক অবস্থানে তপন রায় যে সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেন, সেই এলিট সমাজের উচ্চশিক্ষিত পণ্ডিত ব্যক্তির কিছু কুৎসিত সাম্প্রদায়িক চেহারা আমাদের চমকে দেয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য তিনি সেই লোকদের নাম প্রকাশ করেননি মানহানির দায় এড়াতে।
সমস্ত বইজুড়েই বিভিন্ন রকমের ভ্রমণের বর্ণনা। পৃথিবীর এ-মাথা থেকে সে-মাথা, ইউরোপ, মধ্য এশিয়া, ভারতের জীবনযাপনের একটা তুলনামূলক চিত্রও এতে আছে! তাঁর অক্সফোর্ড ডিগ্রী নেবার পরে ইন্ডিয়ান আর্কাইভস, ইন্ডিয়ান স্কুল অব ইকোনোমিকস এবং দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরী করা নিয়ে ঘটিত বিচিত্র সরস/বিরস ঘটনাবলী পড়ে আনন্দ, বেদনা ও ক্ষোভের সৃষ্টি করে। শুধু তাই না বিশ্বের অনেক বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের নানান বিচিত্র রীতিনীতি যা আমার মতো অভাজনদের কোনোকালেই জানা ছিল না, সেই তথ্যের বর্ণনা আমার জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেছে বিশেষভাবে।
তিনি বিয়ে করেছিলেন এক বিধবা নারীকে, যাঁর একটি কন্যাও ছিল। এ বিয়ের ফলাফলে কোলকাতার বাঙালি সমাজে যে নোংরা প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল, তাতে অনেক প্রগতিশীল বলে পরিচিত মানুষের মুখোশ খসে পড়ার সেই হতবাক করা বর্ণনাও এসেছে এ রচনায়। কিন্তু আবারও দুর্ভাগ্য যে তিনি সে ঘটনার সাথে জড়িত অনেকের নাম প্রকাশে বিরত থেকেছেন।
একটি তথ্য জেনে চমৎকৃত হয়েছি। তপন রায় চৌধুরীর বাবা অমিয়কুমার রায় চৌধুরীকে পুলিশ গ্রেফতার করেছিলেন ১৯৪২ সালে তাঁর বরিশালস্থ গ্রামের বাড়ি (কীর্তিপাশা) থেকে। তাঁর অপরাধ ছিল, তিনি তৎকালীন একটি রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন।
 
কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারের যে অভিযোগ, সেটাকে দুঃসাহসীভাবে নাকচ করে দিয়েছিলেন সে সময়ে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত এক বিচারক। সেই বিচারক হলেন চট্টগ্রামের শিল্পপতি এ কে খান। চট্টগ্রাম শহরের ব্যস্তময় এলাকা 'একে খান মোড়' যাঁর নাম আজও বহন করছে। নিজের শহরের মানুষ বলেই হয়ত এ তথ্যপ্রাপ্তিতে আনন্দটা আরো বাড়তিভাবে অনুভব করেছি।
আরেকটি অংশ পড়েও খুব ভালো লেগেছে। কক্সবাজার নিয়ে তাঁর ছেলেবেলার স্মৃতি। সেই স্মৃতি নিয়ে তিনি লিখেছেন,
"যদি স্বর্গ বলে কিছু থাকে, তার পরে পৃথিবীতে একটিই স্থান আছে সেটি কক্সবাজার। এই পৃথিবীতে পাহাড় সমুদ্র অরণবেষ্টিত সৌন্দর্যের এত অপূর্ব সম্মিলন আমি আর কোথাও পাইনি।"

আমার প্রতিক্রিয়া
বইটি পড়েই অনুধাবন করেছি লেখক নিঃসন্দেহে ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় ইতিহাসবিদদের একজন। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় বোর্ডে প্রথম, প্রেসিডেন্সি হয়ে অক্সফোর্ডে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন, সেখান থেকে ভারতে ফিরে শিক্ষকতা এবং আবার অক্সফোর্ডে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয়া। অবসর নেবার আগে অক্সফোর্ডের সর্বোচ্চ সম্মান ডি লিট অর্জন!
শুধু এখানেই শেষ নয়, ভদ্রলোকের প্রজ্ঞা আকাশের মতন। অসাধারণ এক অ্যাকাডেমিক ব্যক্তি। কোনো একটা বিষয় নিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা বলে গেলেন ব্যক্তিগত ঘৃণা, অপছন্দ বা পছন্দটাকে সরিয়ে রেখে!
বইটির এক চমৎকার বৈশিষ্ট্য হলো, তপন রায় চৌধুরীর আপাত নির্লিপ্ত সরস গদ্য। এই গদ্য পাঠককে টেনে রাখে, পড়তে পড়তে কোথাও মনে হয় না থেমে যাই। দীর্ঘদিন বিদেশে বাস করে বিভিন্ন ভাষায় গবেষণা-শিক্ষকতা করে লেখক কেমন করে বাংলা ভাষার এমন মিষ্টি, ছিমছাম সুন্দর, সাবলীল রূপটা ধরে রেখেছেন, তা ভেবে একটু অবাক হতে হয়।
সব মিলিয়ে এটাকে সত্যি বলতে এটি নিছক কোনো আত্মজীবনী নয়, বরং গত শতাব্দীর বেশকিছু ধোঁয়াশাচ্ছন্ন ঐতিহাসিক পটভূমির একটি প্রামাণ্য দলিল বটে। নিঃসন্দেহে প্রতিটা বাঙালির (হোক সে বাঙাল, ঘটি, বাংলাদেশী বা ভারতীয়) জন্যে অবশ্যপাঠ্য বই। অতএব, নির্দ্বিধায় এটি আপনার পড়ার তালিকায় যুক্ত করে নিতে পারেন।
ভারতের শিক্ষাব্যবস্থার সূক্ষ্ম সব অসংগতি বর্ণনা করেছেন, যা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রেও বেশ ভয়াবহভাবে সত্য। এ অঞ্চলের মানুষদের (বিশেষ করে বাঙালিদের) চিন্তাভাবনা আর মনস্তত্ত্বের একটা সহজ কিন্তু ভয়ের ছবিও দেখিয়েছেন। আমাদের দেশে চলমান প্রেক্ষাপটে এসব আরও সত্য!
লেখক সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী হলেও সে ব্যাপারে অযৌক্তিক কোনো ঘৃণা এই বইয়ে একেবারেই চোখে পড়েনি। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি এবং এর পারিপার্শ্বিকতা নিয়ে বেশ প্রশংসা করেছেন। যদিও তাঁর ছাত্রাবস্থায় এবং শিক্ষকতার সময়ের মাঝেই যে পাশ্চাত্যে উচ্চশিক্ষা পদ্ধতির একটা বড় পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল, সেসব নিয়েও আছে বিশদ আলোচনা। সাথে আছে তাঁর নিজস্ব গবেষণার গল্প।
বইটা পড়তে পড়তে প্রাসঙ্গিকভাবে মনে পড়ে যাবে মিহির সেনগুপ্তের বিষাদবৃক্ষের কথা। কেননা দু'জনই বরিশাল অঞ্চলে জন্মেছেন প্রায় কাছাকাছি এলাকায় এবং দু'জন দু'টো শ্রেনীর প্রতিনিধিত্ব করেছেন। একজন জমিদার শ্রেণীর প্রতিনিধি, অন্যজন মধ্যসত্ত্বভোগী শ্রেণীর প্রতিভূ।
জমিদারী প্রথা উচ্ছেদে এই দুই শ্রেণীর আর্থসামাজিক অবস্থান কি হয়েছিল সেটাও দু'জনের লেখায় পেয়ে যাই।
দেশভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ইত্যাদি বিষয়ে গ্রামীণ চিত্র পাই মিহিরসেনের লেখায়, আর তপন রায়ের লেখায় পাই শহরের চিত্র। সামাজিক অবস্থানে তপন রায় যে সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেন, সেই এলিট সমাজের উচ্চশিক্ষিত পণ্ডিত ব্যক্তির কিছু কুৎসিত সাম্প্রদায়িক চেহারা আমাদের চমকে দেয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য তিনি সেই লোকদের নাম প্রকাশ করেননি মানহানির দায় এড়াতে।
সমস্ত বইজুড়েই বিভিন্ন রকমের ভ্রমণের বর্ণনা। পৃথিবীর এ-মাথা থেকে সে-মাথা, ইউরোপ, মধ্য এশিয়া, ভারতের জীবনযাপনের একটা তুলনামূলক চিত্রও এতে আছে! তাঁর অক্সফোর্ড ডিগ্রী নেবার পরে ইন্ডিয়ান আর্কাইভস, ইন্ডিয়ান স্কুল অব ইকোনোমিকস এবং দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরী করা নিয়ে ঘটিত বিচিত্র সরস/বিরস ঘটনাবলী পড়ে আনন্দ, বেদনা ও ক্ষোভের সৃষ্টি করে। শুধু তাই না বিশ্বের অনেক বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের নানান বিচিত্র রীতিনীতি যা আমার মতো অভাজনদের কোনোকালেই জানা ছিল না, সেই তথ্যের বর্ণনা আমার জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেছে বিশেষভাবে।
তিনি বিয়ে করেছিলেন এক বিধবা নারীকে, যাঁর একটি কন্যাও ছিল। এ বিয়ের ফলাফলে কোলকাতার বাঙালি সমাজে যে নোংরা প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল, তাতে অনেক প্রগতিশীল বলে পরিচিত মানুষের মুখোশ খসে পড়ার সেই হতবাক করা বর্ণনাও এসেছে এ রচনায়। কিন্তু আবারও দুর্ভাগ্য যে তিনি সে ঘটনার সাথে জড়িত অনেকের নাম প্রকাশে বিরত থেকেছেন।
একটি তথ্য জেনে চমৎকৃত হয়েছি। তপন রায় চৌধুরীর বাবা অমিয়কুমার রায় চৌধুরীকে পুলিশ গ্রেফতার করেছিলেন ১৯৪২ সালে তাঁর বরিশালস্থ গ্রামের বাড়ি (কীর্তিপাশা) থেকে। তাঁর অপরাধ ছিল, তিনি তৎকালীন একটি রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন।
কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারের যে অভিযোগ, সেটাকে দুঃসাহসীভাবে নাকচ করে দিয়েছিলেন সে সময়ে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত এক বিচারক। সেই বিচারক হলেন চট্টগ্রামের শিল্পপতি এ কে খান। চট্টগ্রাম শহরের ব্যস্তময় এলাকা 'একে খান মোড়' যাঁর নাম আজও বহন করছে। নিজের শহরের মানুষ বলেই হয়ত এ তথ্যপ্রাপ্তিতে আনন্দটা আরো বাড়তিভাবে অনুভব করেছি।
আরেকটি অংশ পড়েও খুব ভালো লেগেছে। কক্সবাজার নিয়ে তাঁর ছেলেবেলার স্মৃতি। সেই স্মৃতি নিয়ে তিনি লিখেছেন,
"যদি স্বর্গ বলে কিছু থাকে, তার পরে পৃথিবীতে একটিই স্থান আছে সেটি কক্সবাজার। এই পৃথিবীতে পাহাড় সমুদ্র অরণবেষ্টিত সৌন্দর্যের এত অপূর্ব সম্মিলন আমি আর কোথাও পাইনি।"
আমার প্রতিক্রিয়া
বইটি পড়েই অনুধাবন করেছি লেখক নিঃসন্দেহে ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় ইতিহাসবিদদের একজন। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় বোর্ডে প্রথম, প্রেসিডেন্সি হয়ে অক্সফোর্ডে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন, সেখান থেকে ভারতে ফিরে শিক্ষকতা এবং আবার অক্সফোর্ডে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয়া। অবসর নেবার আগে অক্সফোর্ডের সর্বোচ্চ সম্মান ডি লিট অর্জন!
শুধু এখানেই শেষ নয়, ভদ্রলোকের প্রজ্ঞা আকাশের মতন। অসাধারণ এক অ্যাকাডেমিক ব্যক্তি। কোনো একটা বিষয় নিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা বলে গেলেন ব্যক্তিগত ঘৃণা, অপছন্দ বা পছন্দটাকে সরিয়ে রেখে!
বইটির এক চমৎকার বৈশিষ্ট্য হলো, তপন রায় চৌধুরীর আপাত নির্লিপ্ত সরস গদ্য। এই গদ্য পাঠককে টেনে রাখে, পড়তে পড়তে কোথাও মনে হয় না থেমে যাই। দীর্ঘদিন বিদেশে বাস করে বিভিন্ন ভাষায় গবেষণা-শিক্ষকতা করে লেখক কেমন করে বাংলা ভাষার এমন মিষ্টি, ছিমছাম সুন্দর, সাবলীল রূপটা ধরে রেখেছেন, তা ভেবে একটু অবাক হতে হয়।
সব মিলিয়ে এটাকে সত্যি বলতে এটি নিছক কোনো আত্মজীবনী নয়, বরং গত শতাব্দীর বেশকিছু ধোঁয়াশাচ্ছন্ন ঐতিহাসিক পটভূমির একটি প্রামাণ্য দলিল বটে। নিঃসন্দেহে প্রতিটা বাঙালির (হোক সে বাঙাল, ঘটি, বাংলাদেশী বা ভারতীয়) জন্যে অবশ্যপাঠ্য বই। অতএব, নির্দ্বিধায় এটি আপনার পড়ার তালিকায় যুক্ত করে নিতে পারেন।
Post a Comment