উপন্যাসটি পরাধীন বাংলাদেশের পটভূমিকায় উনসত্তেরর গণ অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে রচিত। মোট আটটি ভাগে উপন্যাসটিকে ভাগ করা হয়েছে।

উপন্যাসের নায়ক, গ্রামের এক ক্ষয়িষ্ণু তালুকদার পরিবারের সন্তান। জমি-জিরাত তার পিতার নেই তেমন, কিন্তু উত্তরাধিকারসূত্রে অহমিকা রয়ে যায়। সাধারণ মানুষ আগের মত তাকে সম্মান দিতে চায় না, বা দেয় না, কিন্তু তিনি তার অতীত অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে পারেন না। তার আভিজাত্য, কর্তৃত্ব স্থাপনের মানসিকতা ইত্যাদি প্রবণতাগুলো এলাকার মানুষের পীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাদের কাছ থেকে আগের মত মর্যাদা না পাওয়ার শোধ তিনি তুলতে থাকেন উন্মাদের মতো গণহারে এর-ওর বিরুদ্ধে মামলা করার মাধ্যমে। মামলায় তিনি ক্রমাগত হেরে যেতে থাকেন, তবুও পিছপা হন না।
ছফার ভাষায় বললে,  “পুরনো মডেলের গাড়ি যেমন শহরের নতুন রাস্তায় ঠিকমত চলতে পারে না, ঝঞ্ঝাট লাগায়, দুর্ঘটনা বাধায়, ধোঁয়া ছড়ায়; তেমনি আমার বাবা আমার কালের পৃথিবীতে বসবাসের যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছিলেন। তিনি কেবল দুর্ঘটনার জন্ম দিয়ে যাচ্ছিলেন।"

এসব মোকদ্দমায় তার একান্ত বিশ্বস্ত লোক ছিলেন আবু নসর মোক্তার। কিন্ত মোক্তারের চোখ আবার তার সম্পত্তির দিকে। একসময়ে মোক্তারের কৌশলের কাছে তিনি পরাজিত হন, ধরাশয়ী হন। জমিজমা মোক্তার সাহেবের হস্তগত হয়।

নায়কের পরিবারের এই দুঃসময়ে অকূলের কূল হয়ে আসেন মোক্তার সাহেব নিজেই। তিনি প্রস্তাব দেন, তিনি তালুকদারের চিকিৎসার ব্যবস্থা করবেন, বাড়ি-ভিটে ফিরিয়ে দেবেন, পুরাতন বাড়িটা সংস্কার করে দেবেন। শহরে থাকার ব্যবস্থা হিসেবে একটা বাসা করে দেবেন, ছেলের একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেবেন। এর বিনিময়ে ছেলেকে তার বোবা মেয়েকে বিয়ে করতে হবে। নায়কের পরিবার যদিও প্রথমে এই প্রস্তাব মেনে নিতে চায় না, তবু নায়ক বাধ্য হয়ে বিয়ে করে আবুনসর মোক্তারের বোবা মেয়েকে।

নায়ক শ্বশুরের প্রভাব-প্রতিপত্তির জোরে তার মেয়েকে বিয়ে করে শহরে ওঠে, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে সুবিধাজনক স্থানে চলে যায়। তাদের সাথে শহরে থাকে নায়কের বোন।
একসময় নায়ক তার বোনকে গান শেখানোর ব্যবস্থা করে। কিছুদিনের মধ্যেই তার ভালো উন্নতি হয়। এতে মন ভালো হয়ে যায় নায়কের।

সে আরো বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করে তার বোবা স্ত্রীর গানের প্রতি, গানের যন্ত্রটির প্রতি প্রবল আগ্রহ। ননদটি যখন গলায় সুর তোলে, সেও চেষ্টা করে একইসাথে গলায় সুর তুলতে। তার গলা থেকে বের হয় অন্যরকম আওয়াজ। তবু সে লুকিয়ে লুকিয়ে চেষ্টা করে সুরদেবতাকে ধরতে, ধ্যান করে তার। স্ত্রীর এই প্রচেষ্টা নায়কের ভালো লাগে। তার প্রতি ভালোবাসা খুঁজে পায় সে, যা পায় নি বিয়ের পর থেকে একদিনের জন্যও।

এরপর থেকে, দিনরাত কখনও সে চোখের আড়াল করে না স্ত্রীকে। কাছে কাছে থেকে ভাগ করে নেয় যত 'বকেয়া' ভালোবাসা।

এদিকে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন ঘটতে থাকে। গণআন্দোলনের জোয়ারে আইয়ুব খানের স্বৈরশাসন কেঁপে ওঠে। আমাদের নায়ক মিছিল, শ্লোগান- বিষয়গুলো এড়িয়ে চলতেই পছন্দ করত। মাঝে মাঝে অবশ্য বিরক্তই হত। কিন্তু মিছিলের ব্যাপারে প্রচণ্ড আগ্রহ তার বোবা স্ত্রীর। মিছিল দেখলেই, শ্লোগান শুনলেই তার স্ত্রী অন্যরকম হয়ে যায়।
ছফার ভাষায়, “শ্লোগানের আওয়াজ শুনলে আমার বউটি বিক্ষুব্ধা বাংলাদেশ হয়ে যায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হতে চায়। আর আমার বোবা স্ত্রী কথা বলতে চায়। উভয়ই তর সইতে চায় না। উভয়েরই দাবীই একরোখা।”

একসময় আসাদের মৃত্যুতে চারিদিকে তুলকালাম বেঁধে যায়। চারিদিকে ঘেরাও, জ্বালাও-পোড়াও, অভিযান। একদিন মানুষের মিছিলটাকে খুব ভালোভাবে দেখে নায়ক। মিছিলের সৌন্দর্য মুগ্ধ করে দেয় তাকে।

মিছিলের সৌন্দর্য ছফা এভাবে তুলে ধরেছেন উপন্যাস,
“সেদিন তাকিয়ে দেখলাম মিছিলেরও দেখবার মতো একটি নয়ন ভুলানো সৌন্দর্য আছে। আছে তাতে গতির দোলা, ছন্দের দ্যোতনা। প্রতিটি মানুষ সমগ্র মিছিলের সঙ্গে সন্নিবিষ্ট হলেও তারা সকলে আলাদা আলাদা মানুষ। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সচেতন সবাক চলিষ্ণু ঝরনা একটি আরেকটির সাথে মিশে রচনা করেছে এই গতিমান স্রোতধারা। লক্ষ প্রাণ ঐক্যের মন্ত্রে একসঙ্গে বাঁধা পড়েছে। এমন লক্ষ লক্ষ ঝরণা প্রবল প্রাণতরঙ্গে একসঙ্গে নেচে নেচে উঠছে। মনে হলো মিছিল ভয়ঙ্কর, আবার মিছিল সুন্দর, মিছিলে ধ্বনিত হয় ভাঙনের ধ্বংস নাদ, মিছিলে জাগে নব সৃষ্টির মহীয়ান সঙ্গীত। ভাষণে কোমলে কেমন আপোষ করেছে। দৃষ্টির কুয়াশা ক্রমশঃ কেটে যাচ্ছিলো। সমস্ত বিষয় যথার্থ পরিপ্রেক্ষিতে দেখতে পাচ্ছিলাম। চোখের উপর থেকে আরেকটা আলগা পর্দা যেন খসে পড়লো। সেদিনের মিছিল দেখে, ঠিক মনে হলো, মিছিলে এলে ভীরুতা, কাপুরুষতা ঠিকই ভুলে থাকা যায়। একেবারে হতোদ্যম ক্ষণজীবী মানূষকেও এই মিছিল সামান্য সময়ের জন্য হলেও মহাজীবনের আস্বাদ পান করাতে পারে।"

একদিন এরকম একটি মিছিল তার বাসার দিকে আসছে। শ্লোগানের শব্দ শুনতেই নায়কের বোবা স্ত্রীর অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। সে দেখতে পায় তার স্ত্রী নিজ কণ্ঠ থেকে আওয়াজ বের করতে চাচ্ছে প্রাণপণে।
 একসময় নায়কের মনে হয় তার স্ত্রী “বাংলা” শব্দটি উচ্চারণ করল, তখন তার কণ্ঠ থেকে রক্ত ঝরছে। নায়কের মন ফুরে একটাই প্রশ্ন জাগে- কোন রক্ত বেশি লাল? শহীদ আসাদের না তার বোবা বৌয়ের ?

'ওঙ্কার'-এর কোনো চরিত্রই যেন শুধু একটি ব্যক্তি নয়, বরং বহু কালের, বহু মানুষের ভার বহন করার শক্তি দিয়েই ছফা তাদের সৃষ্টি করেছেন। জনগোষ্ঠীর বহুকালের স্বপ্নকে তিনি সংকল্পে ও অঙ্গীকারে উন্নীত করেন একটি বোবা মেয়েকে দিয়ে, কথা বলার অসম্ভব কাজটি রক্তাক্ত উপায়ে সম্পন্ন করিয়ে, যা মূলত জনশক্তির জাগরণেরই প্রতীক।

Displaying ওঙ্কার - আহমদ ছফা - উপ...
'ওঙ্কার' সম্পর্কে কিছু তথ্য জানিয়ে রাখি।
উপন্যাসটির রচনাকাল ১৯৭২। রচনার তিন বছর পর, ১৯৭৫ সালে এটি প্রকাশিত হয়। আহমদ ছফা এই উপন্যাসটি উৎসর্গ করেছেন তার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক, প্রাজ্ঞ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে।

আবুল ফজল উপন্যাসটার সম্বন্ধে লিখেছেন,
"এ গ্রন্থটি পাঠ করলে যেকোন সুহৃদয় পাঠকই মোহিত হবেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রচণ্ড আবেগ এবং অনুভূতি নিয়ে এর চাইতে উৎকৃষ্ট কিছু কোথাও লিখিত হয়েছে বলে আমার জানা নেই।"

আমার অন্যতম পছন্দের লেখক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এই উপন্যাসটি সম্বন্ধে বলছেন,
"ওঙ্কারে আহমদ ছফা গল্প ফাঁদতে বসেননি, কাহিনীর সূত্র ধরে পাঠককে তিনি টেনে নেন এমন একটি জায়গায়, যেখানে পৌঁছে গল্পটা ভুলে গেলেও কিছু এসে যায় না, কাহিনী গৌণ হয়ে সেখানে প্রবল হয়ে ওঠে অনেক দিনের অনেক মানুষের গ্লানি, জড়তা ও শোষণ এবং গ্লানি থেকে মুক্তির রক্তাক্ত সংকল্প" ।


এ উপন্যাসকে ঘিরে একটি মজার ঘটনা ছফার একটি সাক্ষাতকার থেকে পাই।

হুমায়ূন আহমেদ, আনিস সাবেত আর আহমদ ছফা মিলে একবার গিয়েছেন আনিস সাবেতের গ্রামের বাড়িতে। সেখানে কোনো একটা বিষয় নিয়ে আনিস সাবেত আর আহমদ ছফার মধ্যে তুমুল কথা কাটাকাটি শুরু হয়। ছফা বলছেন, "আনিস সাহেব, আপনি আপনার মত উইথড্র করুন।"

আনিস সাবেত বললেন, "আমি মরে গেলেও আমার কথা উইথড্র করব না।"
ছফা বললেন, "তবে আমি চললাম।" বলে হনহন করে হাঁটা শুরু করলেন।
হুমায়ূন আহমেদ বললেন, "আনিস ভাই, ছফা ভাইকে আটকান। উনি চলে যাচ্ছেন যে!"
আনিস সাবেত আয়েশি ভঙ্গিতে বললেন, "ছাড়ো তো। এই রাত বিরাতে উনি যাবেন কোথায়? গাড়ি-ঘোড়া কিছুই তো পাবেন না যে ঢাকা চলে যাবেন। একটু পরে এমনিই ফিরে আসবেন।"

ছফা কিন্তু ফিরে আসেননি। সারারাত হেঁটেই তিনি ঢাকা চলে গেলেন। পরে যখন আনিস সাবেত এই ঘটনার জন্য ক্ষমা চেয়েছেন তখন ছফা সাহেব বলেছিলেন, সারা রাত হেঁটে ভালই হয়েছে। মাথায় নতুন একটা উপন্যাস এসেছে।

আহমদ ছফাকে এক সাক্ষাতকারে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, বাংলা- সাহিত্যে কোন উপন্যাসটিকে তিনি ক্ল্যাসিক উপন্যাস হিসাবে মনে করেন।
কোন রকম ভুমিকা না করে তিনি জবাব দিয়েছিলেন, "আহমদ ছফার 'ওঙ্কার'।

পাঠককে আশ্বস্ত করতে পারি, সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদ পাবেন এ উপন্যাসটিতে।

Post a Comment

Previous Post Next Post