আজ বিকেলের নাশতার সময়ে যখন পিঙ্কুর বাবা আমাকে বললেন, "রোকসানা, তুমি কল্পনার জগতে বাস করছ" -ঠিক তাঁর এই কথাটি শুনে বুকের মধ্যে কেমন এক শূন্য অনুভূতি ঘিরে ধরল। পৃথিবীর সবকটা মানুষের মত আমিও তো নিজেকে বাস্তববাদী দাবী করি। আমার নিজের কাছে নিজেকে তো বাস্তববাদী বলেই মনে হয়। বাজার-সদাই করাকালে তো বিক্রেতার সাথে দামদর করি বেশ আগ্রহ নিয়েই। রিকশাচালক বা অটোরিক্সাচালককেও ছাড় দেই না। হুট করে কারো মুখনিঃসৃত বাক্যকে বেদবাক্য বলে মেনে নিই না। 
এই তো সেদিন, পিঙ্কু ক্লান্তবিষণ্ণ মুখ নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলতে লাগল, "আম্মি, আমার খুব জ্বর। আজকে ইংলিশ টিচারের কাছে যাব না।" 
আমি মেয়ের প্রতি মমতা থেকেই ওর জিভের নিচে সরু থার্মোমিটারটি বসিয়ে দিলাম। এবং তাতেই মিনিটখানেকের মধ্যে সত্য-মিথ্যা যাচাই হয়ে গেল। সেই আমাকেই কি না পিঙ্কুর বাবা - মানে আমার প্রিয়তম স্বামী - বললেন, আমি নাকি কল্পনার জগতের বাসিন্দা!
আমার অহংবোধে গিয়ে লাগল ব্যাপারটা। আমার চারপাশে আমি এমন সবকিছু ছড়িয়ে রেখেছি, যাতে আমার স্বামীর বক্তব্যের উলটোটাই প্রমাণিত হয়। তবুও এমন কী দেখলেন তিনি, যাতে আমাকে কল্পনাচারী বলে মনে হচ্ছে তাঁর। আমি আমার মুখে সেই প্রশ্নটাই ফুটিয়ে তুললাম। আমার প্রশ্নবোধক মুখের দিকে এক নজর তাকিয়ে তিনি হাসলেন এবং আবার নজর ফেরালেন হাতের রিডার্স ডাইজেস্টে। ওদিকে যে তাঁর কথাটুকু আমি ডাইজেস্ট করতে পারছি না, সেটার জন্যে যে আমার ধৈর্যের পরীক্ষা চলছে, এবং তাতে যেন ফেল না করতে হয়, তাই যে চুপ করে অপেক্ষায় আছি; এই কষ্ট কি তিনি বুঝবেন?
আমি যে জগতের কিংবা যে মেজাজের মানুষই হই না কেন, আমার প্রিয়তম স্বামী- বিশিষ্ট প্রফেসর এবং খামারী আলী হায়দার সাহেব- বাস্তব জগতের একজন ঠাণ্ডা মেজাজের মানুষ। আজ পর্যন্ত কত বছর সংসার করছি? হিসেবে ধরলে পনেরটা বছর কেটে গেল৷ আমার ঠিক মনে পড়ে না যে এই পনেরটা বছরে আমাদের দু'জনের মাঝে তুচ্ছ কিংবা গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ে তর্ক বা ঝগড়া হয়েছিল কি না৷
 যাঁর মেজাজ এমন হিমালয়ের বরফের মত ঠাণ্ডা এবং যাঁর ব্যক্তিত্ব সেই হিমালয়ের মতই দৃঢ়, তাঁর সাথে তো নিজের শত গরজেও ঝগড়া কিংবা তর্কের ইচ্ছেটা একেবারেই আসতে চায় না। আর তার উপর তাঁর সেই বিখ্যাত স্মিত হাসি। পনের বছরে অনেক কিছু বদলালেও এই হাসিটা বদলায়নি। এখনও তাই কিশোরীদের মত মুগ্ধ, আবেগী ও প্রেমপূর্ণ চোখে চেয়ে থাকি তাঁর হাসির দিকে। পিঙ্কু পেয়েছে হায়দার সাহেবের আদল, আর আমার স্বভাব। তাই তো মিথ্যে অজুহাত বানিয়ে তা সকাল-বিকেলের নাশতার সাথে সে পরিবেশন করে। অবশ্য মাঝেমাঝে পিঙ্কুও তার বাবার মত নির্বিকার বসে থাকতে পারে। ঠিক যেমন পিঙ্কুর বাবা এখন আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়েই চুপ মেরে বসে আছেন।
"কী ব্যাপার, বললে না তো কল্পনার জগতে বাস করার মত কী এমন করি?" 
ডাইনিং রুমের বড় ঘড়িটা ঢং ঢং শব্দে বেজে ওঠল। আমার প্রিয়তমের কান সেদিকে খাড়া হয়ে গেল। যদিও তাঁর হাতে হাতঘড়ি আছে। ঢং ঢং রবে চারবার বেজে ওঠল ঘড়ি। তিনি এরপর তাঁর হাতঘড়িতেও নজর বুলালেন। অতঃপর হাতের ম্যাগাজিনটি ভাঁজ করে টেবিলের উপর রেখে ওঠে দাঁড়ালেন। এখন তিনি একটু খামারের দিকে যাবেন।
ভুল বললাম, একটু নয় বরং অনেকক্ষণের জন্যেই যাবেন। দূরত্বও কম নয় সেটির। ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায়। খামারের গাভী-বলদগুলোর সাথে কীসের এত আলোচনা তাঁর, কে জানে! কর্মচারীদেরও একই পাল্লায় মেপেছি। তাদের জন্যে হায়দার সাহেবের সময় আছে, আর আমার প্রশ্নের জবাবের জন্যে একটুও সময় নেই।
ইদানিং রাতের খাওয়াদাওয়ার পাট পিঙ্কুর বাবাকে ছাড়াই চুকে নিতে হচ্ছে। এরপর পিঙ্কুকে খানিকক্ষণ পড়া দেখিয়ে দেয়া, ঘুম পাড়িয়ে দেয়া, ঘরের অবশিষ্ট কাজগুলো মিটিয়ে নেয়া, পরদিনের কাজের একটা খসড়া তৈরি করে নেয়ার পর আর হাতে কোনো কাজ থাকে না। শরীরে থাকে পুরো দিনের জমানো ক্লান্তি। কিন্তু মন সায় দেয় না বিছানার বুকে ছড়িয়ে যেতে। আমরা যেদিকটায় থাকি, সেখান থেকে পনের মিনিট পশ্চিমপথেই সমুদ্র। কাছাকাছি থাকি বিধায় ছুটির দিনগুলোয় পিঙ্কুর বাবাকে নিয়ে মাঝেমাঝে ঘুরে আসি। সে সময়ে অবশ্য তিনি নির্বিকার থাকেন না। বরং থেকে থেকে গলায় সুর ভাজেন। একবার লজ্জার মাথা খেয়ে তো গান গাইতে গাইতেই আমার ঠোঁটে......সেটা ভিন্ন আলাপ, সেটাকে এখানে আজ ঠাঁই নাইবা দিলাম।
কিন্তু এ সময়টায় আমি বড় একা। বোধকরি স্বামী-সন্তানের সান্নিধ্য কিংবা ভালোবাসা পাওয়ার পরেও নিজের অস্তিত্বের একটি অংশ তবুও অতৃপ্ত থেকে যায়। সে অংশটা একান্তই নিজের। একে তৃপ্ত করা লাগে নিজেকে যথেষ্ট সময় দিয়েই।
তাই বরাবরের মতই হাতে ছোট্ট ভ্যানিটি ব্যাগ নিয়ে মাথায় ঘোমটা চেপে দরজা লক করে বেরিয়ে পড়লাম। না, আমি কোনো স্বাধীনচেতা নারীর মত দায়িত্বের শৃঙখলে হাঁপিয়ে পড়ে হারিয়ে যাচ্ছি না। আমার গন্তব্য বেশি দূরের নয়। সমুদ্রের পাশ বেয়ে যে সরু পাকা রাস্তাটি নদীর মত ঈষৎ এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে, তার উপর দিয়েই একটা রিকশায় চেপে মাইল দুয়েক ঘুরে আসা। এই সামান্য ঘুরে আসার মাঝেই যে আমি কত গভীরতার এক অনাবিল আনন্দ-সাগরে ডুবে যাই, আমার মাঝে লুকিয়ে থাকা কবিটা যে কীভাবে জেগে ওঠে, সেই অনুভূতিটুকু আমার নিজের সেই একান্ত অস্তিত্বের অংশটির জন্যেই বরাদ্দ। তার উপর সোনায় সোহাগারূপে আকাশে আজ চমৎকার চাঁদ ওঠেছে। এখন চাঁদকে নিয়ে সুকান্তের সেই ঝলসানো রুটির তুলনায় নামব, নাকি সৈয়দ শামসুল হকের লেখা "চাঁদের সাথে আমি দেব না, তোমার তুলনা" -গানটি গাইব; এসব ভাবতে ভাবতেই রিকশা পেয়ে গেলাম। 
"একটা শুধু চক্কর দিয়ে আসবেন কালিরহাট থেকে।" সময়ের হিসেব মনে মনে করাই ছিল। কালিরহাট হয়ে ঘুরে আসতে আসতে সব মিলিয়ে পঁচিশ মিনিটের মতই সময় লাগবে। সেটাই যথেষ্ট। এবং এ রিকশাচালককেও আমি চিনে ফেললাম। প্রায় রাতে তো তাঁর রিকশাতেই ওঠেছি। আমাকেও চিনতে পেরে হেসে ফেললেন তিনি। 
রিকশায় চেপে বসতেই জোর নিটোল বাতাস বইতে শুরু করল। চোখেমুখে সেই পরশ মাখতে মাখতেই আমার মনে হলো, রাতের পৃথিবী নিয়ে যে মানুষের এত নাক-সিঁটকানো মনোভাব, এতটা দ্বেষ, সেটা বোধহয় পুরোপুরি ঠিক নয়। রাতেরও যে আলাদা সৌন্দর্য আছে, তা কবিমাত্রই স্বীকার করেন। তা না হলে রবীন্দ্রনাথ কেন গাইবেন, "আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে!"


আমি আশেপাশে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছি। প্রতি রাতেই একই দৃশ্য চোখে পড়ে। তবুও চোখ জুড়োয় না। কিছুটা নিঝুম পরিবেশ, সমুদ্রতটে দাঁড়িয়ে থাকা ঘন ঝাউবনের সারি, সমুদ্র থেকে বেরিয়ে আসা সমুদ্র শাখার উলটে পড়ে থাকা নৌকো; কিছুটা ছমছমানি এনে দিলেও তা আমার মুগ্ধতাবোধকে ছাপিয়ে যেতে সক্ষম হয়নি। আমি নিজের অজান্তেই গান তুলে ফেললাম গলায়। এবং নিজের গলার সুরে নিজেই বেশ অবাক হলাম। বোধকরি পরিবেশের মাধুর্যতা এবং নিঝুমতা আমার কণ্ঠের আবেশকে বেশ পালটে দিয়েই কিশোরীদের মত সরু ও চিকন করে ফেলেছে। মুখরা, অন্তরাসহ পুরো গানটাই একসময় গেয়ে ফেললাম। ভেবেছিলাম, রিকশাচালক দু-চার শব্দে কিছু প্রশংসা করবেন। তা তিনি করেননি। একনিবিষ্ট মনে রিকশাকেই তিনি টানতে লাগলেন।
এই রিকশাযাত্রাতেই এবং চমৎকার জোছনাময় উজ্জ্বল রাতের আবহেই আমি মুখে মুখে একপ্রস্থ কবিতা তৈরি করে ফেললাম। আমি সেটি মুঠোফোনে রেকর্ডও করে রাখিনি, কাগজ-কলম ছিল না বলে লিখেও রাখিনি। শুধু আমার এ কাব্যের সাক্ষী হয়ে রইলেন রিকশাচালক ভাই, যার নামটাও আমি জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন মনে করিনি। ক'জনই বা করে।
ফিরতে ফিরতে রাত পৌনে একটা। ততক্ষণে আকাশের চাঁদ বড় এক জমাটবদ্ধ মেঘে ঢেকে গেছে। তাই আশপাশ বেশ অন্ধকার। আমি দরজার লক খুলতে যাব, এমন সময়েই বাগানের একপাশ থেকে গলা খাঁকাড়ি দিয়ে কেউ আমার মনোযোগ আকর্ষণ করল। আমি পেছন ফিরে তাকালাম। একটা ছায়ামূর্তি। সেটি ধীরে ধীরে আমার কাছে আসতেই দেখলাম তিনি আমার প্রিয়তম স্বামী। সবাই যাকে সফল খামারী জনাব আলী হায়দার নামেই চেনেন। কবি কাজী নজরুল ইসলামের মত হাতের মাঝে হাত ভাঁজ করা ভঙ্গিতে তিনি আমার সামনে দাঁড়ালেন। তাঁর মুখে সেই শীতল, স্মিত হাসি। আর এদিকে আমি সঙ্কোচে স্থির হয়ে পড়েছি।
তিনি হাসিমুখেই বললেন, "রোকসানা ম্যাম, আপনার কল্পনার জগতের ভ্রমণ সাঙ্গ হলে এবার বরং ভেতরে যাওয়া যাক।"
আমি বিনা বাক্যব্যয়ে দরজার লুক খুলে ভেতরে ঢুকলাম। হায়দার সাহেবকে খাইয়ে দিয়ে রাতের বিছানায় তাঁর বুকে প্রতি রাতের মতই মুখ লুকিয়ে শুয়ে পড়লাম।
Post a Comment