মুগ্ধ হয়েছিলাম রবীন্দ্রনাথের কাব্যধর্মী উপন্যাস 'শেষের কবিতা' পড়ে। সেই মুগ্ধতা আকাশ পরিমাণ বেড়ে গেল 'ঘরে বাইরে' পড়ার পর। এবং পড়েই বুঝলাম বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের তুলনা শুধু রবীন্দ্রনাথই। বাংলা আর বাঙালির নিকট রবীন্দ্রনাথ ভিন্ন গতি নেই। কেন নেই, সেটা এই উপন্যাসটা পড়ার পরে আরেকবার অনুভব করলাম।

রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক উপন্যাস হিসেবে যখনই উল্লেখ করতে হয়, তখনই সবার আগে 'ঘরে বাইরে'র নাম সকলের মুখে চলে আসে। মূলত স্বদেশী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটেই এ উপন্যাসটি রচিত।
গল্পের মূল চরিত্র তিনটি- বিমলা, নিখিলেশ আর সন্দ্বীপ। বইয়ের সবটুকু অংশই এ তিনটি চরিত্রের কারো না কারো জবানিতে প্রকাশ পেয়েছে। তিনজনের আত্মকথায় তাদের জীবনবোধ এবং রাজনৈতিক বোধ প্রকাশ পেয়েছে প্রবলভাবে।

পড়তে গিয়ে আমার মনে হল, এরা তিনজন কেবল তিনটি চরিত্র নয় বরং সে সময়ের বাংলার তিন ধরনের চিন্তা-বিশ্বাসের মানুষ। তাদের চিন্তা ও রাজনৈতিক মতাদর্শের পার্থক্য যেন সেই সময়ের বাংলাকেই প্রকাশ করছে।

উপন্যাসটি পাঠ করতে গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে যে পরিচয়টা বড় হয়ে উঠেছে, সেটা হল একে শুধু রাজনৈতিক উপন্যাসের জনরায় ফেলে দিলেই হবে না, বরং এটি সম্পর্কের টানাপোড়েন আর মনস্তত্ত্বভিত্তিক উপন্যাসও বটে।

তিনটি চরিত্রই চান বা না চান, মানুষ হয়ে জন্মানোর দায়ে একটা করে মন তাদের অধিকারে আছে। সেই মন যে পাগল মন, সে যে কত কথা বলে তার কি ঠিক আছে!

মানসিক দ্বন্দ্ব, চাওয়াপাওয়া, শূন্যতাবোধ এবং টানাপোড়েন নিয়েই মূলত এ উপন্যাসের প্রতিটি অধ্যায় এগিয়েছে।

এই মানসিক টানাপড়েনের মূলে আবার রয়েছে সম্পর্কের টানাপোড়েন।



নিখিল ও বিমলা স্বামী-স্ত্রী। একটা সময়ে তাঁদের মাঝে প্রবেশ করে সন্দ্বীপ। না, শুদ্ধবাদী ঋষি রবীন্দ্রনাথ এখানেও কোনো পরকীয়া আনেননি। কিন্তু সবকিছুর পরেও মানুষের মন এক রহস্যে ঘেরা বস্তু, তার কোনো হিসেব চলে না। সন্দ্বীপের ব্যক্তিত্ব শেষের খানিকটা অংশ বাদে প্রায় পুরোটা উপন্যাস জুড়েই আচ্ছন্ন করে রাখে বিমলাকে। অন্যদিকে সন্দ্বীপও তাঁর প্রতি বিমলার এ মুগ্ধতাকে ব্যবহার করতে ছাড়ে না।

ওদিকে নিখিল যেন অন্যজগতের কেউ, যে মনুর সন্তান হয়ে জন্মে ভুল করে ফেলেছে, দেবকুলেই তার জন্ম নেয়া উচিৎ ছিল।

মানুষ তো চিরকাল মানুষের মাঝেই থাকে, মানুষ তাই মানুষের কাছে একান্তই আটপৌরে বস্তুসম। তিনবেলা খাবারে ভাতের চেয়ে যে মানুষের বছরের দু'বেলার খাবার পোলাও-কোর্মা ভালো লাগে, তা তো মানুষের দুর্বলতা। মানুষ হিসেবে সে দুর্বলতা আমাদের সকলেরও আছে, তা অস্বীকার করব না।
 আর তাই এই জগতের বিমলা বা সন্দ্বীপের চেয়ে অন্য জগতের মানুষ নিখিলেশের প্রতি একরকম পক্ষপাত কাজ করে আমার।

সন্দ্বীপ আগের পাওয়ার কথা বলত, নিখিলেশ বলত সেই পাওয়ার পরের পাওয়া। সন্দ্বীপের আগের পাওয়া আমরা পেয়ে গেছি, কিন্তু নিখিলিশের পরের পাওয়াটাকে সম্ভবত চেয়েছি সবচেয়ে বেশি, অন্তত এখন চাইছি। তাই নিখিলেশের প্রতিই আমার পক্ষপাত। শুধু আমার কেন, আমার ধারণা রবিঠাকুরও তার প্রতি পক্ষপাত দেখিয়েছেন।

সম্পর্কের টানাপোড়েন, উত্থান-পতন, মানবিক-মানসিক দ্বন্দ্ব আর তার মাঝে রাজনৈতিক আদর্শ-বিশ্বাস নিয়ে লিখতে লিখতে স্বাভাবিকভাবেই গল্প ঝুঁকে গেছে একদিকে। আর সব আন্দোলনের মত স্বদেশী আন্দোলনেরও বেশকিছু নেতিবাচক দিক ছিল, সেগুলো স্পষ্টভাবেই ফুটে ওঠেছে উপন্যাসে।
এই ঝুঁকে যাওয়াটা কি কেবল গল্পেরই কোনো এক চরিত্রের ঝুঁকে যাওয়া, নাকি ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথও সেদিকে ঝুঁকে ছিলেন, তা বলতে পারি না। অবশ্য তা জানার তেমন আগ্রহও নেই। সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথকে চিনতে পারলেই খুশি, ব্যক্তিকে কেই বা চিনতে পারে?

ব্যক্তিগতভাবে আমিও স্বদেশী আন্দোলনের পক্ষে নই সেভাবে। শুরুতে আদর্শ ঠিক ছিল কি না জানি না, তবে পরে যে তা উগ্রতার কেরোসিনে পুড়ে যায় তা নিশ্চিত। হিটলারের শেখানো দেশপ্রেম উগ্রতার আগুনে সারা পৃথিবীকে পুড়িয়েছে। যে ধোঁয়া এমনিতে পুড়লে সুগন্ধ ছড়ায়, কেরোসিনের আগুনে পুড়লে সেই সুগন্ধও যেন চাপা পড়ে যায়।

সে যাক, স্বদেশি আন্দোলনের ইতিহাস যতটা জানি, তাতে আমার মনে হয়েছে ভারতবাসীর বা বাঙালির স্বার্থ না, কলকাতাবাসীর একটা গোষ্ঠীর স্বার্থেই ব্যবহার হয়েছে এই আন্দোলন।
তবে আমার ভাবনাই শেষ কথা না। এর বাইরেও অনেকে ভাবেন। সেকালেও ভাবতেন।

সেরকম অনেকেই রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখে তাদের আপত্তির কথা জানিয়েছিলেন। আমি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রকাশিত সংস্করণ পড়েছি। তাতে উপন্যাসের শেষে ভিন্নমতপোষণকারী অজ্ঞাতনামা এমনই এক বঙ্গরমণীর এক চিঠির জবাব দেয়া আছে, যা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ দিয়েছিলেন সবুজপত্র পত্রিকায়।

সেই জবাবের ভাষাতেই বলি, লেখকের গল্প লেখার উদ্দেশ্য গল্প লেখাই। গল্প-চিত্রকলা বা অন্যকোনো শিল্পমাধ্যমের যে অন্তরতম রস, পাঠক যদি নিজের বলয় থেকে বেরিয়ে তা পান করতে না পারেন, তবে দুর্বলতা লেখকের না, পাঠকেরই।

সুখপাঠ্য এ উপন্যাসটি আপনাকে শুরু থেকে শেষোবধি ধরে রাখবে বলেই আমার বিশ্বাস। রবীন্দ্রনাথকে নতুনভাবে চেনার এ আরেক অন্যতম উৎসও বলতে পারেন। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের প্রথম চলিত ভাষায় লেখা এ উপন্যাসটি বর্ণনাও বেশ সাবলীল ও খুব সাহিত্যরসসমৃদ্ধ। তাই অনায়াসেই পাঠ করে যেতে পারবেন।

Post a Comment

Previous Post Next Post