জঙ্গল, অথচ ঠিক জঙ্গলের মত নয়,
যতদূর চোখ যায়, চোখে পড়ে ঘন গাছের সারি,
ইতস্ততবিক্ষিপ্ত পাতার আড়ালে নিবিড় ছায়া।
এ জঙ্গলে হিংস্র জন্তু নেই,
নেই তাই হিংস্রতাও।
একে তাই অরণ্য না বলে বাগানও বলা যায়।
কিছু কিছু শালগাছ বেশ কচি,
বোধকরি সরকারি উদ্যোগে রোপণ করা,
নবীন যুবার মত তাদের ছিপছিপে দেহ।
সব মিলিয়ে বেশ ঝকঝকে পরিষ্কার,
ঝুপসি ডালপালা কিংবা লতা-ঝোঁপের বিশেষ বাধা নেই।
নির্বিঘ্নেই পা চালিয়ে হেঁটে যাওয়া যায়।
.
আমরা তিনজন।
বাকি দু'জনের নাম যুবাইর, মাসুম
জ্ঞানীর ভঙ্গিতে যুবাইর হাঁটছে, পরখ করছে গাছের ডালপালা।
আর নামের মতই নিষ্পাপ চোখমুখ নিয়ে গোবেচারা মাসুম তাকাচ্ছে ইতিউতি।
জঙ্গল নিয়ে নানারকম কৌতূহল মনে জাগছিল,
একটু পরে সেসব মন থেকে মুছে গেলে অরণ্যের আচ্ছন্নতা হৃদয়কে ধরল ঘিরে।
চুপচাপ হাঁটতে লাগলাম,
শুকনো পাতায় আমাদের ভারী পায়ের আওয়াজ শুধু।
সরু সরু পায়ে-চলা পথ পেরিয়ে এলাম বড় রাস্তায়,
জঙ্গল কেটে সেই রাস্তা বেরিয়ে চওড়া হয়েছে,
ফাঁকা রয়েছে।
তার এক প্রান্তে খুব আড়ম্বর ও জাঁকজমকের সঙ্গে সূর্যাস্ত হচ্ছে।
পাতলা পাতলা মেঘ ছেদ করে সূর্য ছড়াচ্ছে তার রাশি রাশি গাঢ় লাল রঙ,
গাছের চূড়ায় সেগুলো পৌঁছোতেই হয়ে যাবে সোনালি,
খুব একটা শেষ রঙের খেলা চলছে।
.
এমন জমকালো সূর্যাস্ত তো সচরাচর পড়ে না চোখে,
এসব শুধু দেখা যায় দক্ষ পরিচালকের সিনেমায়,
কিংবা পাকা হাতের ফটোগ্রাফিতে।
যুবাইর হয়ত সেজন্যেই বলে ফেলল,
"মনে আছে, গার্ডেন অফ ইভল-এ বার্ট ল্যাঙ্কাস্টার?"
মাসুম জবাব দিল, "উঁহু, ওই সিনেমায় বার্ট ছিল না, ছিল গ্যালি কুপার আর রিচার্ড উইডমার্ক। আর নায়িকার কথা মনে আছে?"
নিরীহ মাসুমের চোখের কুৎসিত নেচে ওঠার অসামঞ্জস্যতা হাসি এনে দিল আমাদের মুখে।
আমি বললাম, "ছবি তুললে অনেক কিছুই ভালো দেখায়,
এখানে এই সূর্যাস্তের ছবি তুললে তোদের ওই সিনেমার দৃশ্যের চেয়েও ভালোভাবে ফুটত।"
যুবাইর মাথা নেড়ে বলল, "বেশ বলেছিস, সূর্য তো সেই একটাই। সিনেমার সূর্যটা তো সৌরজগতের একক সূর্যটাই।"
.
একটা বেশ প্রশস্ত সিমেন্টের কালভার্ট।
আমরা বসে পড়ে নিজেদের ধকল সামলে নিলাম।
দূরে একটা শেয়াল দাঁড়িয়ে,
সে ভীত, আমাদের মাসুমের মতই।
ধীরে ধীরে আলো কমে এসে,
প্রথমবারের মত জঙ্গলে নামল আঁধার,
আর তার খানিক পর রাস্তার শরীরে পড়ল কালো ছায়া।
স্তব্ধ জঙ্গল যেন আরো স্তব্ধতায় মূঢ় হয়ে এলো।
যৌবনে এই প্রথম,
বছর দশেক বাদে,
গা'টা ছমছম করে ওঠল।

Post a Comment

Previous Post Next Post