গল্পময় পরিবেশের মাঝে থেকেও গল্পের সংকটে ভোগা লাগে, কিছু ইতস্তত মুহূর্তে। হারাতে হয় গল্প লেখার তীক্ষ্ণ ক্ষমতা। শুয়েবসে কাটাতে হয় কিছু ছিন্নভিন্ন মুহূর্ত। দিন যায়, রাত আসে, প্রতিদিন একইভাবে। বেলাশেষে সূর্যটা নেমে পড়ে। একেকটি দিনের সমাপ্তি নেমে যায়, একেকটি আত্মগ্লানি মনকে ঘিরে ধরে। দিনের পেরিয়ে যাওয়ার পর মনে একটি বাক্যেরই আক্ষেপ ওঠে জেগে, "আজও কোনো গল্প লেখা হয়ে ওঠলো না।"
এখানেই গল্পকারের দুশ্চিন্তা। তার চিন্তার একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু তার স্বহস্তে লিখিত গল্প। গল্পকার গল্প পড়ে, শেখার জন্যে। প্রচুর গল্প পড়ে নেয়ার পর লেখার কাগজের টুকরোগুলো একত্র করে কলমটা মুখে নিয়ে, ইনিয়েবিনিয়ে সে ভাবতে বসে, কীভাবে প্লটের পথটুকু সে পাড়ি দিবে। ভাবতে বসলে ঘটনাপ্রবাহ তার মাথায় আসে না। তবে লিখতে গেলে তা কিছু ক্ষেত্রে চলে আসে অনায়াসেই।

প্রতিটা ঘটনাপ্রবাহের পুঙ্খানুপুঙ্খতার দিকে সে নজর দেয়ার চেষ্টা করে। নিছক গল্প বলার মত করে সে লিখতে চায় না। সাদামাটা, অন্তঃসারবিহীন বর্ণনায় সে আনন্দ পায় না, তৃপ্ত হয় না। যদিও জটিল শব্দের সম্মিলনের জটিল বাক্যের ঠাসবুননকে সে সমর্থন করে না। তবে একেবারে সস্তা বাক্যকেও সে মেনে নিতে পারে না।

কলমকে পিষে পিষেই, মগজটাকে খাটাতে খাটাতেই সে অস্থিরতায় ক্ষেপে ওঠে। কারণ, একটি কালিও বেরিয়ে আসেনি কলমের শীষ থেকে। গল্পকার যদি হয় চশমাধারী, তবে সে তখন চশমাটুকু চোখ থেকে বিচ্ছিন্ন করে তা রেখে দেয় লেখার কাগজের পাশে। নিজের পিঠটুকু ঠেলে দেয় সামান্য পেছনে। দু'হাত একত্র করে মাথার পেছনে রেখে তার মাঝেই চেপে ধরে সেই মাথাকেই। চোখদু'টো বন্ধ করে ডুবে যায় অন্ধকারে। যেন সেই আলোহীন জগতে কোনো উৎকৃষ্ট কিছুর সন্ধান সে পেয়ে যাবে। যেন সেখানে ছড়িয়েছিটিয়ে আছে যাবতীয় অলিখিত ঘটনাপ্রবাহ, যা আর কারো কলমে পৌঁছায়নি আজো। সেই জগতে বারবার ঘুরে আসার পরও গল্পকারের স্বস্তি আসে না। এক গাঢ় অস্বস্তিপূর্ণ অনুভবে ডুবে গিয়ে সে রুষ্ট হয়। সেই রুষ্টতার ছাপ তার চোখের ভ্রুযুগলের কুঁচকে ওঠার মাঝে স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে।

বাহিরের পরিবেশটা একেক মুহূর্তে একেক চিত্র ধারণ করে। গল্পকারের এই অস্বস্তিকর স্তব্ধ হয়ে পড়ার মুহূর্তগুলোয় বাহিরের পরিবেশ কখনও থাকে উত্তপ্ত, কখনও আর্দ্র, কখনও বা বর্ষমান। প্রকৃতির উপাদানের প্রতি ফাঁকে-ফোকরে চলতে থাকে পবনের গদ্য লেখা। গাছের পাতাময় ডালের নেচে ওঠার ছন্দে সেই পবন হয়ত কোনো কাব্যও রচনা করে বসে। বজ্রধ্বনির মাঝে কোনো দৃঢ় কণ্ঠস্বরে হয়ত সে কোনো প্রতিবাদের গল্প শোনায়। 

অথচ এর কোনোটিই স্পর্শ করে যায় না গল্পকারকে। সে নিস্তব্ধতার সাথে কাটিয়ে দেয় তার অস্বস্তিকর মুহূর্তগুলো। উত্তপ্ত পারিপার্শ্বিকতায় সে মাথার উপরের পাখাটুকু ছেড়ে দেয়। বর্ষণমুখর মুহূর্তগুলোয় সে বৃষ্টির ঝাপটা রুখতে জানালার কপাট দেয় লাগিয়ে। বজ্রপাতের মুহূর্তগুলোয় সে ঘরেই অবস্থান করে। এবং এসবের মাঝেই সে প্রমাণ করে দেয় যে সে একজন কবি নয়, বরং গল্পকার। তার মাঝে তাই কবির মত ভাবালুতা নেই, আছে কিছু স্বার্থচিন্তা। গল্পকারেরা স্বার্থচিন্তাতেই তো ডুবে থাকেন। কবিদের মত ছন্দময় মন ও উদারতা তাদের খুব একটা নেই।

প্লট না পেয়ে গল্পকার ওঠে দাঁড়ায়। অনুভব করে এক কাপ চা-পানের তৃষ্ণা। চুলোয় বসিয়ে দেয়  কেটলি। বয়সভেদে চিনি-দুধের বেশকম ঘটিয়ে চা'টুকু তৈরি করে সেটি কোনো সিরামিক, মেলামাইন বা কাঁচের ছোট্ট কাপে ঢেলে দেয় সে।  চায়ের কাপ হতে ধোঁয়ার উড়ে যাওয়াকে সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে করে পর্যবেক্ষণ। দৃষ্টিটুকু থাকে ধোঁয়ায়, তবে চিন্তাটুকু থাকে বিচ্ছিন্নতায়। গল্প হতে তার সাময়িক বিচ্ছিন্নতা। 

এমন বিচ্ছিন্নতা তার লেখক জীবনে বারবার এলেও সেই অস্থিরতার অনুভূতি ও পরিমাণ থেকে যায় একইরকমই। প্রতিবারই এই ধারণা হতে থাকে, "এই বুঝি আমার গল্প লেখায় টান পড়লো। আর বুঝি গল্প লেখা হবে না।" প্রতিবারই পড়ে যাওয়া লাগে এক জমাটবদ্ধ আত্মগ্লানির ডোবার নিষ্প্রাণ জলে। এবং প্রতিবারই কোনো না কোনো আবহ তাকে সেখান থেকে তুলে আনেই। কাগজের পর কাগজ ধরে সে লিখে যায় অজস্র গল্প। ফিরে পায় আত্মবিশ্বাস। ডুবে যায় আনন্দে। পরম আনন্দের সেই সরোবরে পা ডুবিয়ে সে মননে, মগজে মাখতে চায় আত্মসন্তুষ্টি। এবং পুনরায়, কোনো এক (শুভ বা অশুভ)ক্ষণে স্তব্ধতা এসে ধরা দেয় তার গল্প লেখার নড়বড়ে হাতটায়।

একটা সময় চায়ের কাপ শূন্য হয়। কাপের তলায় জমে থাকে কয়েক ফোঁটা চা। তাতে ভাসতে থাকে চায়ের পাতার চারটি-পাঁচটি ক্ষুদ্র দানা। গল্পকারের শরীরে প্রবেশ করে নেয়া চায়ের তরল অংশগুলো চলে যায় তার পেটে। এবং সেই চায়ের সতেজ অংশগুলো উঠে পড়ে তার মগজে। মগজের প্রতিটি নিউরনে অনুরণন জাগিয়ে সেই সতেজতা হটিয়ে দেয় যাবতীয় প্রতিবন্ধকতাকে। চঞ্চলতা পায় তার চিন্তা, তার ভাবনা। হাঁফ ছাড়ে তার মগজ। সহজ বাংলায় বলতে গেলে, তার মাথাটা খুলে যায় এই সতেজতার স্পর্শে। খুব দ্রুত চায়ের কাপটুকু ধুয়ে নিয়ে সেটি যথাস্থানে রেখে সে ফিরে আসে নিজের গল্প লেখার টেবিলে, টেনে ধরে বসে পড়ে সেই কাঠের চেয়ারে।

এবার কলমটুকু তুলে নেয় হাতে। তর্জনী, মধ্যমা ও বুড়ো, এই তিন আঙ্গুলের মাঝে কলমটুকু চেপে ধরে সেটিকে সামনে-পেছনে ঘোরাতে থাকে সে। গল্পের শুরুর বাক্য নির্বাচনে সে সামান্য দ্বিধায় পড়ে যায়। তবে এতদিনের গল্প লেখার অভিজ্ঞতাটুকু তাকে কিছু একটা মনে করিয়ে দেয়। সে শুরু করে দেয়,

"কাঁঠাল গাছের শক্ত ডালের পাশে মস্ত পাকা কাঁঠালের মতই ঝুলে আছে এক মানবীর দেহ, যার গলাটা দড়িতে পাকানো। সেই মানবীর গর্ভে লুকিয়ে আছে এক মানবশিশু, যার পিতা সেই মানবীরই শ্রদ্ধেয় ভাসুর। লজ্জা, অপরাধবোধ, এবং গ্লানিই আজ তাকে ঝুলিয়ে দিল এই কাঁঠালের ডালে। শ্রদ্ধেয় ভাসুর আছেন বেঘোর ঘুমে। স্বামী আছেন প্রবাসে। আকাশের সূর্যটা এখনও ওঠেনি জেগে।"

এভাবেই গল্পটুকুর শুরু হয়, এভাবেই গল্পটুকুর শেষ হয়। গল্পকারের কলম থেমে যায়। তার গল্পের তালিকায় যুক্ত হয় আরো একটি ছোটগল্প।

গল্পকার ওঠে দাঁড়ায়। দরজা খুলে ছাদে চলে আসে। আকাশের দিকে তাকায়। আকাশের গভীরতা মাপে। আকাশের সীমানা খোঁজে। উড়ে যাওয়া পাখির চঞ্চল ডানার ঝাঁপটানো দেখে। দূর আকাশে দূরদেশী বিমানের এগিয়ে চলাটুকু দেখে।

আরো দেখে দখিনা আকাশে কালো মেঘের জমে যাওয়াটুকু। সেটি ধেয়ে আসছে, ধীরে ধীরে, বাতাসের বেগের সাথে তাল মিলিয়ে।

ঠিক সেই মুহূর্তে সেই গল্পকারের মনে একজন কবি হয়ে ওঠার সাধ জাগে। তবে সেই সাধকে সে প্রশ্রয় দেয় না।

কবি হওয়ার মাঝে যদি স্বতন্ত্র আনন্দ থাকতে পারে, গল্পকার হওয়ার মাঝেও আছে ভিন্নধর্মী আনন্দ।
টুপ করে বৃষ্টির ফোঁটা গল্পকারের চশমার কাঁচেই গড়িয়ে পড়লো। আর থাকা যাচ্ছে না ছাদটায়। নেমে পড়া লাগবে। আরো গল্প লেখা লাগবে।

Post a Comment

Previous Post Next Post