কবিদের ব্যাপারটা চমৎকার। তারা চমৎকার কল্পনায় নিজেদের ডোবাতে পারেন যে কোনো মুহূর্তেই, যে কোনো পারিপার্শ্বিকতায়। কবিদের জগতটা আলাদা রকম হলেও সে জগতে যাওয়ার উদ্দেশ্যটুকু এক ও অভিন্ন। শান্তি, স্বস্তি, এ দু'টোর সন্ধানেই তো সে জগত থেকে তাঁরা কিছু সময়ের জন্যে নিজেদের ঘুরিয়ে আনেন।
কবিদের কবিতা পড়তে গিয়ে তাই আমার ঈর্ষাবোধ হয়। আহা, তাঁদের কতই না সৌভাগ্য। এই বাস্তব জগত ছাড়াও তাঁদের আলাদা আরেকটি জগত আছে। সেই জগতেও হয়ত এই বাস্তব জগতের মতই নদী আছে, তাতে চমৎকার লহরীময় তরঙ্গ আছে, তাতে ভেসে চলা ময়ূরী নৌকা আছে। আরো আছে চমৎকার কিছু কল্পনার মুখ। 
প্রেমের কাব্য পড়তে গিয়ে তো সেটাই লক্ষ্য করি। কল্পনার তুলিতে তারা কতই না যত্ন করে রোমান্টিসিজমের আলপনা আঁকে। আরো আঁকে কল্পনার প্রেয়সীর সুশ্রী মুখটি। তাকে নিয়ে ছন্দ গড়ে, সাজায় অন্ত্যমিল। তার হাসিতে মুছে ফেলে অন্তরের গ্লানি। তার জন্যে কথা দেয় আকাশের চাঁদ-তারা খসিয়ে আনার। খুব অবাস্তব হলেও বেশ চমৎকার অনুভূতি জাগে এসব পড়তে গিয়ে।
তাহমিনা বরাবরের মত সেদিনও বলে ফেললো,
"কাইয়ুম, তুমিও এমন করে আমার জন্যে একটা কাব্য লিখে ফেলো না। যেন আমিও ভাসতে পারি তোমার গড়া রঙিন নায়ে। যেন আমিও সেই হৃদের জলের ছোঁয়া পেতে পারি। যেন আমিও ঘুরে আসতে পারি তোমার গড়া সেই কল্পনার দেশ থেকে। প্লিজ, লিখে ফেলো না!"
আমি পরোটা ভেঙ্গে তা ডালের সবজিতে ডুবিয়ে মুখে পুরে ফেলি। খেতেই খেতেই যা জবাব দিই, তা তাহমিনা ঠিক বুঝে ওঠতে পারে না।
- আহ কাইয়ুম, মুখে খাবার নিয়ে কথা বোলো না তো। কিছুই বুঝলাম না। আগে খাবার খেয়ে মুখটা খালি করো।
মুখের পরোটা চিবোতে চিবোতেই আমি হেসে ওঠি। হাতের ইশারা দিয়ে আশ্বস্ত করি। তাহমিনা হয়ত আশ্বস্ত হয়। তবে সে চুপ করে থাকে। তার দীর্ঘ নীরবতাটুকু আমাকে বেশ অস্বস্তিতে ফেলে দেয়।
: তাহমিনা, চুপ কেন?
- তুমি আগে খেয়ে নাও তো।
: এই তো, প্রায় শেষ হয়ে এলো।
আমি পেতলের গ্লাসটি কাত করি শূন্য থালার উপর। ডান হাতের সমস্ত আঙ্গুলগুলো ধুয়ে ফেলি। হোটেল বয়কে ডেকে এনে টিস্যু চেয়ে বসি। হাতটা মুছে নিই। বিল পরিশোধের জন্যে বড় নোট দিয়ে ভাংতির জন্যে অপেক্ষা করি। ভাংতি হাতে পাই। ম্যানেজারের টেবিলের পাশে ছোট পিরিচে রাখা জিরার কয়েকটি দানা মুখে পুরে নিয়ে বেরিয়ে যাই।
- এখন শোনো কাইয়ুম। যা বলছিলাম, কানে কি গিয়েছে?
: হ্যাঁ তাহমিনা। গিয়েছে। একেবারে অন্তরাত্মা পর্যন্ত গিয়ে সেটিকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। 
- ঠাট্টা করছো?
: তুমিও তো তাই করছিলে এতক্ষণ?
- আমি আবার কেমন ঠাট্টা করছিলাম?
: এই যে যা আবদার করলে, কাব্য লেখার আবদার। তোমাকে রঙিন নায়ে ভাসিয়ে আনার, সেই কল্পনার দেশে ঘুরিয়ে আনার এমন অন্যায় আবদার....।"
- দাঁড়াও, দাঁড়াও! কী বললে!? কী আবদার!?
: অন্যায় আবদার। স্বরে 'অ', দন্ত্য 'ন' 'য ফলা' 'আ'কার, অন্তস্থ 'য়'। 'অন্যায়'। Injustice.
- এভাবে বানান করে কেন বললে? এসবের মানে কী?
: অন্যায় আবদার এজন্যেই যে, যা আমার ধাতে নেই, তা আমাকে করতে অনুরোধ করা।
- ধাতে নেই কোনটা?
: আরে বোকা! সেটাও আলাদা করে বুঝিয়ে বলা লাগবে। কাব্যে...কাব্যচর্চায় আমার ধাত নেই। তাই তাতে আবদার করাটাও অন্যায়। এবং সেটা ঠাট্টারই শামিল।
.
আমার এমন উত্তপ্ত জবাব শুনে হয়ত তাহমিনার মনটা ক্ষুণ্ণ হয়েছিল। সে জবাব দেয়াটাই বন্ধ করে দিল। আমি পাত্তা দিলাম না। আমাকে বাস ধরতে হবে। মুড়ির টিনসদৃশ ভার্সিটির বাস। তাতে ওঠতে হবে ছুটতে ছুটতে। ঝুলতে হবে তার ভেতরে। ঘামতে হবে। অন্যের ঘামও গায়ে মাখাতে হবে আতরের মত। নামতে হবে বাম পা ফেলে। ক্লাসে ছুটতে হবে উদভ্রান্তের মত। নোট টুকে রাখতে হবে সাংবাদিকদের মত। এতসব জরুরী কাজ ও সেসবের দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে রাখি সর্বক্ষণ। কাব্যচর্চার আবদারটুকু তখন বিলাসিতার মতই মনে হতে থাকে।
লাইব্রেরিতে মাঝেমাঝে যাই। এক টুকরো লাইব্রেরি কার্ড তৈরি করেছিলাম ভার্সিটিতে ভর্তির পর। খুব কমই আসা হয় এখানে। আমার ক্লাসনোটগুলো আমি ক্লাসে বসেই করে ফেলি। এখানে মাঝেমাঝে আসি লেখকদের দরজায় কড়া নাড়তে। কড়া নাড়ি। তাঁরা দরজা খুলে দেন। তাঁদের সাথে আলাপ করি। তাঁরা বলতে থাকেন, আমি অনুধাবন করতে থাকি। তাঁদের ভাবনার শত বিভিন্নতা টের পেয়ে অনুভব করি নিজের চিন্তাগত ক্ষুদ্রতাকে। একটা সময়ে তাঁদের আলাপের অর্ধেকেই ওঠে পড়ি। তাঁদের গুছিয়ে রাখি শেলফের যথাস্থানে।
আজও এক লেখকের দরজায় কড়া নেড়ে তাঁর সাথে আলাপ করছি। লেখকের নাম মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি আমায় শোনাচ্ছেন 'জীবনের জটিলতা'। আমি শুনছি, হাসছি, ভাবছি। 
তাহমিনা তখন সামনে বসে পড়লো। জানতে চাইলো, 
- কী ব্যাপার, সে সময়ে জবাবটা পেলাম না যে।
আমি মুখ তুলে চশমার ফাঁক দিয়েই তার দিকে তাকালাম। হরিণী চোখ, ফর্সা গাত্রবর্ণ, পিঙল কেশবতী তাহমিনার দিকে আমি বেশিক্ষণ চেয়ে থাকতে পারি না। তার চেহারাটাও তত স্পষ্ট হয়ে ওঠে না আমার কাছে। আমি বইয়ে চোখ নামিয়ে বললাম,
: বিদেয় হলে বেশ খুশি হবো। আমি বেশ ব্যস্ত।
- সেটা আগে বললে কি আরো ভালো করতে না!? 
আমি চুপ করে বইয়ের বাক্যের উপর চোখ বুলাতে লাগলাম। প্রতিটি বাক্যে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করছি। পাঠ্যবইয়ের বাইরে এসবই তো পড়া হয়। এছাড়া আর কোনোকিছু আমার চোখে সয় না, রুচিতে রোচে না।
- কাইয়ুম, আমার জন্যে দেখি তোমার কোনো সময়ই নেই। আমার জন্যে কি একটু আবেগও তুমি ধারণ করতে পারো না নিজের মাঝে? আমি আসলেই শুধু দূর দূর করে তাড়িয়ে দাও কেন? এভাবে তো আর চলতে পারি না।
তাহমিনা দ্রুত চলে গেল। এবং তখনই আমি এক গাঢ় শূন্যতায় ডুবে গেলাম। একটা হাহাকারময় শূন্যতা। গ্রীষ্মের দুপুরের কড়া রোদময় শূন্য ময়দানেও এতটা হাহাকার বোধকরি ছেয়ে থাকে না। শূন্যতাটুকু আমায় যেন ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিচ্ছিল। আমি বইয়ের বাক্যে মন রাখতে পারছিলাম না আর। অর্থহীন ঠেকছিল সেসব। আমার বোধশক্তি, মনোযোগ, সব তো তাহমিনাই নিয়ে গেল সঙ্গে করে। আমি আর কী করে সেসবকে আঁকড়ে ধরতে পারবো?
- স্যার!
ছাত্রের ডাকে ঘোর ভাঙলো। 
: কী হলো?
- আমি একটা প্রশ্ন করেছি, স্যার।
: কখন করলে?
- এইমাত্রই করলাম। আপনি খেয়াল করেননি?
আমি ঘোরে ডুবে গিয়েছিলাম, সেটা ছাত্রকে জানতে না দিয়ে দোষটা স্বীকার করে নিলাম।
: "অহো সরি, খেয়াল করিনি। আবারও বলো।"
ছাড়াছাড়া এমন বেখেয়ালে প্রায়ই পড়ে যেতে লাগলাম। ঘোর এমনভাবে আমাকে ডুবিয়ে নিয়ে যায় যে, সেখান থেকে ওঠে আসতে কখনও ছাত্রের ডাক, কখনও বাস-কন্ডাকটরের ডাক, অথবা কখনও মায়ের ডাকের প্রয়োজন হয়।
- কীরে কাইয়ুম, কী নিয়ে এত ভাবিস?
মায়ের এমন প্রশ্নের সরাসরি জবাব না দিয়ে পালটা প্রশ্ন দিয়েই পাশ কেটে যাই,
: তুমিও তো কতকিছুই ভাবো আমাদের জন্যে। সেসব কি কখনও বলেছ?
মা ভাবনায় হারিয়ে যান। ধীরে ধীরে ফিরে যান নিজ কক্ষে। আমার খুব খারাপ লাগতে থাকে। নিজের উত্তর লুকোতে মাকে বিব্রত করার অপরাধে বইয়ের পাঠে, মনোযোগের চাদরে মুখ লুকাই।
পরদিন ক্লাস শেষ হলো। আমি ক্লাসরুমেই বসে রইলাম। সবুজ, রিমন, আশরাফ, তানসীর, ওসমান, আরকান, কারো ডাকেই সাড়া দিলাম না। ওরা ক্যাফেটেরিয়ায় লাঞ্চ করতে যাচ্ছে। 'আমার খিদে নেই এখন, পরে যাব' বলে ওদের বুঝ দিলেও আমার বক্তব্য সত্য ছিল না। খিদে বেজায় লেগেছে। তবে একটু নিভৃতে থাকতে চাচ্ছিলাম শূন্য রুমটায়। 
ভাবনায় নিজেকে ডুবিয়ে ফেললাম। দু'হাতের উপর নিজের থুতনিকে ভর করে দেয়ালের কোণে ওৎ পেতে থাকা টিকটিকির দিকে চেয়ে রইলাম। মাথায় কিছু একটা এসে গেল। 
চশমাটা বুকপকেটে ঝুলিয়ে রেখেছিলাম। সেটা চোখে পুরে নিলাম। ব্যাগের জিপ খুলে খাতা আর কলম বের করে আনলাম। ম্যানেজমেন্ট নোট করি যে খাতায়, তার শেষ পৃষ্ঠা টেনে ছিঁড়ে ফেলে তার উপরেই কলমকে পিষতে লাগলাম।
"লহরি যদি বয়ে চলে নদীর,
আমি তোমার পানে চেয়ে থেকে অধীর,
নেমে নেমে হয়ে যাব গম্ভীর।"
কাব্যচর্চা। উঁহু। হচ্ছে না একেবারেই। অন্ত্যমিল হলেও বক্তব্যটি ফুটে ওঠছে না ঠিকভাবে। তিনটি পঙক্তি কেটে দিলাম একটানে। 
"কাজলকালো নয়ন তোমার, যেন সমুদ্র,
তার তটে দাঁড়িয়ে নিজেকে লাগে খুবই ক্ষুদ্র।"
দ্বিতীয় প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হলো। আবেগ আসছে না। যা আসছে, তাকে পড়ে মনে হচ্ছে কৃত্রিম তোষামোদ। সেটাও কেটে দেয়া হলো।
"আমার বুকের মাঝে জ্বালা আছে,
আমার মনের মাঝে কথা আছে,
সখী, তোমার মনের আঙিনায়,
আমি আছি তোমার ভাবনায়।"
না, হলোই না। একেবারে বাংলা সিনেমার গানের লাইনের মত লাগছে। পুরোটা টেনে দিলাম।
ধুর! কিছুই হচ্ছে না কেন! কেন পারছি না! কেন মাথায় একটা চমৎকার আবেগজাত কাব্য আসছে না! কেন আমি ততটা রোমান্টিক নই! এতসব 'কেন'র উত্তর মাথায় আসছিল না। দু'হাতে চোখ দু'চেপে হাতের উপর ভর করে ঝিম ধরে বসে রইলাম।
- কাইয়ুম, এখনও আছ তুমি?
কানে যেতেই চোখ থেকে হাত সরিয়ে ফেললাম। তাহমিনা বসে আছে, ঠিক দু'টো বেঞ্চ সামনেই। আমার দিকে চেয়ে হাসছে। 
: তুমি কখন এলে তাহমিনা?
- এই তো, একটু আগেই।
: নিঃশব্দে এলে কী করে?
- আমি সশব্দেই এসেছি। তবে তোমার কাছে তো আমি খড়কুটোর মতই মূল্যহীন। সে কারণেই বোধকরি আমার সশব্দ উপস্থিতিও তোমার কাছে শব্দহীন বলে মনে হলো।
আমি কথা বাড়ালাম না। হাতে তখনও সেই কাগজের টুকরোটি ছিল। সেটি মুচড়ে নিয়ে ফেলে দিলাম, পাছে তাহমিনার চোখে পড়ে যায়।
- অ্যাই, ওটা কী ফেললে?
: তেমন কিছু না। বাজে কাগজ।
তাহমিনা ওঠে গিয়ে সেটি কুড়িয়ে নিতে গেল। 
ঠিক তখনই বাহির থেকে সবুজ আমাকে দেখতে পেয়ে থেমে গেল। দ্রুত ছুটে এসে অস্থির স্বরে সে বললো,
- কীরে কাইয়ুম, তুই এখানে?! আমরা তোকে পুরো ফ্যাকাল্টি জুড়ে খুঁজলাম! তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আয়! এখানে থাকাটা নিরাপদ না।
আমি বিনাবাক্যব্যয়ে বেরিয়ে পড়লাম সবুজের সাথে। ভাগ্যিস, সবুজ তাহমিনাকে লক্ষ্য করেনি। তবে একটা ভুল হয়ে গেল। তাহমিনাকেও তো সাবধান করতে হবে। তবে ততক্ষণে বেশ দূরে চলে এসেছি। 
ফ্যাকাল্টি থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত টিচার্স কলোনীর বাগানের কাঁঠালগাছের ডালে সোশ্যালজি ডিপার্টমেন্টের অনার্স তৃতীয় বর্ষের এক ছাত্রের ঝুলন্ত লাশ পাওয়া গেছে। তার মুখটা কালো কালিতে মাখা। ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল উধাও। আঙ্গুল কাটা অংশ থেকে জুসের পাইপের মত সরু রগ বের হয়ে আছে। বাম পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলও উধাও। 
খুব সম্ভব ছেলেটি ভার্সিটির বেগুনী দলের কোনো গুরুত্বপূর্ণ কর্মী ছিল। বেগুনী দলটি বর্তমান সরকারেরই একটি পোষ্য দল। তাই সরকার-বিরোধী পক্ষের গড়ে তোলা গোলাপী দলের উপর গিয়ে পড়লো অজস্র অপবাদ। ভার্সিটি ক্যাম্পাস কিছুক্ষণের মাঝেই রণক্ষেত্রে পরিণত হবে। সে কারণেই সবুজ আমাকে টেনে এনেছিল। তারা নাকি ক্যাফেটেরিয়ায় খেতে পারেনি। সরাসরি খাবার টেবিলের উপরেই নাকি বেগুনী দলের লাঠিয়াল বাহিনী আক্রমণ করে বসে। তারা কোনোরকমে ছুটে এসেছে। আমার খোঁজ করছিল। কারণ আমরা একসাথেই বাড়ি ফিরি। 
- খালি ক্লাসে করছিলিটা কী?!
আমি সবুজকে তো বলতে পারি না যে আমি প্রেমকাব্য চর্চা করছিলাম। চেপে গেলাম তার প্রশ্নটা। 
সন্ধ্যেবেলায় আর ট্যুইশন করাতে গেলাম না। চোখের সামনে সেই ঝুলন্ত লাশের দৃশ্যটুকুই ভেসে ওঠছে। যদিও সে যে ফাঁস খেয়ে মরেনি, এটা ওপেন সিক্রেট। তবুও লাশের কালিমাখা মুখ দেখেও কেন যেন মৃত্যুকালীন তার যন্ত্রণাটুকু কতটুকু তীব্র ছিল, তা কিছুটা হলেও অনুভব করতে পারছিলাম। গায়ের রঙটা প্রায় ফর্সার কাছাকাছি ছিল ছেলেটার। চুলগুলো বেশ নরম ও কিছুটা লম্বা ছিল। খুব সম্ভব, ছেলেটা সুপুরুষ ছিল দেখতে। এবং আরো জোর তাগিদের সাথে বলতে পারি, তার কোনো না কোনো প্রিয়তমাও ছিল। 
আমি তাহমিনার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলাম। আজকাল ওকে খুব চেষ্টা করেও খুঁজে পাই না। তবে আজ পেলাম।
- কী ব্যাপার কাইয়ুম, আজ তোমাকে অস্থির মনে হচ্ছে কেন যেন? 
: হ্যাঁ তাহমিনা। কিছুটা অস্থির, কিছুটা বিষণ্ণ, এবং অনেকটা ক্লান্ত।
- ট্যুইশনেও যাওনি বোধহয়। কারণ, এ সময়টাতে তো তুমি আমার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করো না।
: হ্যাঁ, ঠিক ধরেছ। আজ গেলেও পড়াতে পারতাম না। 
- আচ্ছা। বিশ্রাম করো তাহলে।
: তুমি ভালো আছো তো?
- ভালো আছি মানে, অনেক বেশি ভালো আছি। তোমার ছুঁড়ে ফেলা 'বাজে কাগজ'-এর বাজে কবিতাগুলো আমি পড়ে দেখেছি। ভালোই তো লিখছিলে কবিতাগুলো। কেটে দিলে কেন? আর ফেলেই বা দিলে কেন?
আমি লজ্জা পেলাম। তবে একটু আনন্দবোধ হতে লাগলো এই জেনে যে আমার রসহীন কবিতাগুলো তাহমিনার পছন্দ হয়েছে।
- চুপ করে আছো যে?
: আমি তোমার সাথে ভার্সিটিতেই কথা বলবো। সেখানেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবো তোমার বিষয়ে।
- অ্যাই, এসব কী বলছো? তুমি কি পাগলটাগল হয়ে গেলে নাকি? 
: কেন, তুমি কি আমাকে ভালোবাসো না?
- হ্যাঁ, বাসি তো।
: তাহলে? 
- ঠিক আছে। কাল বোধহয় একেবারে ঘোষণাই করে দিবে ব্যাপারটি।
: কাল নয়। কয়েকটা দিন পর। ভার্সিটির সব ক্লাস বাতিল হয়েছে, জানো না?
- আচ্ছা। তাহলে যখনই যাও, তখনই ঘোষণা দিয়ে দিবে?
: অনেকটা তা-ই।
রাতে ভালো ঘুম হলো। চমৎকার অনেকগুলো স্বপ্ন দেখলাম। স্বপ্নের নায়ক আমি, নায়িকা তাহমিনা। অনেক চমৎকার স্বপ্নের সাথেসাথে কিছু রসময় গুপ্ত ধরনের স্বপ্নও দেখে ফেললাম। যা ছিল তাহমিনাকে ঘিরেই। আমার দোষ কী? স্বপ্ন তো আমার হাতে নেই। 
এত কিছুর আনন্দে আমি ভুলেই গেলাম যে আমি আজ জীবনে প্রথম একটি ঝুলন্ত লাশ দেখেছি, যার হাত ও পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুল দু'টি নেই।
কয়েকটা দিন বাদে ভার্সিটির পরিস্থিতি শান্ত হলো। সময়ের চেয়ে একটু আগেই ভার্সিটি ক্যাম্পাসে পৌঁছালাম। ক্যাম্পাসের বাইরে একটি ফুলের দোকান দেখে আসছি সেই বহুদিন ধরেই। 'পুষ্পকানন' নামটির কারুকার্য দেখেই দোকানে ঢুকে পড়তে ইচ্ছে করে। আজ প্রথম ঢুকলাম। ফুলের দাম সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। তবুও তিনটি গোলাপ কিনে নিলাম। সেগুলোকে একত্রে বেঁধে দিলেন দোকানদার। নিয়মিত কাজ। তাই ভাবলেশহীন মুখে খুব স্বাভাবিকভাবেই তিনি কাজটি করলেন। অথচ এদিকে আমার লজ্জা ও সঙ্কোচ ছিল তুঙ্গে। ফুল নির্বাচন, ফুলের দাম জিজ্ঞাসা ও ফুল ক্রয় করার প্রতিটি পর্যায় আমি পার করেছি এক জমাটবদ্ধ লজ্জাময় অনুভূতি নিয়ে। তবে সাথে ছিল এক টুকরো চাপা আনন্দবোধ।
একটা খালি বাক্স কিনে নিলাম। আইসক্রিমের প্লাস্টিকের বাক্স। তাতে গোলাপ তিনটি রেখে ব্যাগে পুরে ফেললাম। ব্যাগে সরাসরি রাখলে সেগুলো ভর্তা হয়ে যাবে। আর তাছাড়া আমার হাতে গোলাপ দেখলে বন্ধুদের রসিকতার তীরে জর্জর যাওয়া লাগবে।
ওসমানের সাথে মুখোমুখি হতেই সে আমাকে দেখে বললো,
"কাইয়ুম শোন। আজ সন্ধ্যায় আমার বাসায় আসিস। কাজ আছে।"
ওসমানের বাসায় মাসের প্রায় প্রতি সপ্তাহেই আমার দাওয়াত পড়ে। ভুল বললাম। শুধু আমার না, আরো কয়েকজনের দাওয়াত পড়ে। সে একজন কবি। প্রায় সব বিষয়েই ছাড়াছাড়াভাবে কবিতা লিখলেও প্রেমকাব্য বোধহয় তার প্রধান দুর্বলতা। সেগুলোই সে লেখে, আর সপ্তাহান্তে আমাদের ডেকে নিয়ে আবৃত্তি করে শোনায়। তার কবিতা আমি বুঝি না। তবে তার আবৃত্তির গলা বেশ চমৎকার। সেই আবৃত্তির টানেই বোধহয় আমি তার নিমন্ত্রণ রক্ষা করি।
ক্লাসে আজ কেন যেন মন বসাতে পারলাম না। তবে স্যারের দিকে চেয়ে এমনভাবে মাথা নাড়ছিলাম, যেন তার বক্তব্যের সবটুকু বুঝে গেছি। 
ক্লাস একসময় শেষ হলো। আমাকে ওঠে যেতে দেখে আরকান বলে ওঠলো,
"কীরে কাইয়ুম, আজ কি সূর্য দক্ষিণ দিকে ওঠলো?"
আমি বললাম, "একথা বলছিস যে?"
সে তার দাড়িময় গালে হাত বুলিয়ে একগাল হেসে বললো,
"না মানে, তোকে তো ক্লাস শেষে ক্লাসনোট করতে দেখি। সবার শেষে, একেবারে শূন্য ক্লাস থেকে তুই বেরিয়ে পড়িস। আর আজ কি না ক্লাস শেষ না হতেই ছুট।"
আরকানের কথার জবাব দেয়ার প্রয়োজন মনে করলাম না। ওদের মনটা অবশ্য তেমন অনুসন্ধানী গোছেরও নয়। আমি জবাব না দিলে যে ওরা আমাকে অনুসরণ করবে, তেমন কোনো সম্ভাবনা একেবারেই নেই। আমি তাই নিশ্চিন্ত মনে আমার গন্তব্যের দিকে কিছুটা দ্রুত পায়ে এগোতে লাগলাম। আমার গন্তব্য 'ক্যাফেটেরিয়া'র পাশের সেই কফি হাউসটা।তাহমিনার কাছে মনের সবটুকু প্রকাশ করে দেয়ার সেই শুভক্ষণের দিকেই যাচ্ছি। আমার উত্তেজনার পরিমাপ আজ শুধু আমিই করতে পারছি। 
সন্ধ্যেবেলা। খুব সম্ভব পৌনে সাতটা বেজে গিয়েছে। সন্ধ্যেও পেরিয়ে গেছে। আমি চুপচাপ বসে আছি একটি নীল রঙের নাতিদীর্ঘ প্লাস্টিকের টুলের ওপরে। সবাই এসে গিয়েছে, শুধু রিমন আসেনি। 
আমাকে পাশ থেকে তানসীর টোকা দিল। আমি চোখ তুলে তাকালে সে ইশারায় সময়টা জানতে চাইলো। আমি আমার হাতঘড়িটি তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। সে একটু ঝুঁকে সময়টা দেখে নিয়ে অস্ফুট স্বরে বললো, "এখনও সময় আছে।"
ওসমান এসে প্রবেশ করলো কক্ষে। তার হাতে একটা ক্লিপ বোর্ড। তাতে কয়েক প্রস্থ কাগজ আটকানো। মুখটা তার হাসি হাসি। আমরা সবাই এসেছি তার কাব্যের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে। আমাদের সবার দিকে চেয়ে সে বলে ওঠলো,
"কীরে, রিমইন্যা আসে নাই?"
সবুজ জবাব দিল, "আরে ওর নাকি ট্যুইশন আছে। ইন্টারের একটা পরীক্ষার্থী, সামনেই নাকি তার একাউন্টিং পরীক্ষা।"
আরকান বললো, "পরীক্ষার্থী না, বল পরীক্ষার্থিনী।"
ওসমান রাগমাখা স্বরে বললো, "এক 'প'-এর কাজের নাম কইরা আরেক 'প'-এর কাজ করতে গেছে, বুঝলি? 'পড়ানো'র নাম কইরা 'প্রেম' করতে গেছে। দুইটা শব্দের শুরুই তো 'প' দিয়া। হাহাহা।"
সবাই হেসে ওঠলো। আমি হাসলাম না। এত সহজে আমার হাসি পায় না।
"আচ্ছা ও না আসলে না আসুক। তোরা তো আইছস। তোগোরেই শুনাই। এটা আমার সাতান্ন নম্বর কবিতা। রচনা করেছি গত রাত তিনটে বেজে কুড়ি মিনিটে।"
ওসমানের কথাবার্তায় আঞ্চলিকতার সুর থাকলেও আবৃত্তির সময় সে সম্পূর্ণ আঞ্চলিকতামুক্ত হয়ে পড়ে। তার রেশটা কিছুক্ষণ আগেই এসে পড়লো। 
ওসমান শুরু করলো;
"মনোমাঝে জমে গেছে সারি সারি মেঘ,
রবির কিরণ ঢেকে গেছে, চেয়ে দ্যাখ।
তোর ছবি, মোর ছবি, ভেসে ওঠে তাতে,
তোর নামে প্রাতে, আর আমারটা রাতে।
আমি মুখ লুকিয়েচুকিয়ে ঢেকে রাখি
শুধু তোর মুখ পানে চেয়ে চেয়ে থাকি।
করতে চাই না তোকে বৃথা কুপোকাত,
ফেলে এসেছি বিষাদেরই করাত।
মনে পড়ে, তোকে ঘিরে এঁকেছি স্বপন,
জমিয়েছি ঢের হীরে-মানিক-রতন।
তারা গুণে, দিন গুণে, হয়েছি বিভোর,
বিনিদ্র চোখে কত পেরিয়েছি ভোর।
তোর নামে জড়োয়া কিনেছি একজোড়া,
দিয়েছি শত শত গোলাপেরই তোড়া।
ভালোবেসে, কাছে এসে, বুকে চেপেছি
তোর নামে, নিজ বিবেচনা মেপেছি।
শরতের আকাশের মত ছিল মন
তোর কারণেই বর্ষা ঘিরলো তখন।
ছেড়ে দিয়ে, না করেই তোর শত জেরা,
তোকে ভাবতাম, জগতে তুই-ই শুধু সেরা।"

বাকি কবিতা কানে যাচ্ছিল না। আমি ঘোরে চলে গিয়েছিলাম। ঠিক সেই দুপুরের মুহূর্তে নিজেকে আবারও নিয়ে গেলাম। ক্যাফেটেরিয়ার পাশের কফি হাউসের দক্ষিণের টেবিলে বসে আমি প্রতীক্ষায় ছিলাম তাহমিনার। প্রতীক্ষায় ছিলাম তার আগমনের। প্রতীক্ষায় ছিলাম তাকে তিনটি গোলাপের বন্ধনে জড়িয়ে নিতে।
না, না। এমন নয় যে, সে আসেনি। সে এসেছে। হাসিমুখেই এসেছে। তার হরিণী চোখে আমি উচ্ছ্বাস দেখেছিলাম। সে এসেই চেয়ারটুকু টেনে বসে পড়লো। তারপর মুগ্ধ চোখে আমার দিকে চেয়ে থাকলো। 
- কাইয়ুম, কেমন আছ?
আমি বেয়াড়াকে ডেকে দু'মগ কফির ফরমায়েশ দিলাম।
- কাইয়ুম, আমার জন্যেও কি কফি আনতে বললে?
: হ্যাঁ, বললাম। কেন, তুমি কফি খাও না?
সে হাসলো। মিষ্টি হাসি। বোধহয় তার কফিতে চিনিও দেয়া লাগবে না। তার হাসির মিষ্টতা কফিতে মিশে গিয়ে সেটাকেও মিষ্টি করে তুলবে।
- কাইয়ুম, আজ প্রপোজ করবে?
: হুম।
- 'হুম' কী আবার! মুখে বলো।
: হ্যাঁ, করবো।
- কী করবে?
: ভালোবাসার নিবেদন করবো। 
তিনটি শব্দের উচ্চারণের পরই লক্ষ্য করলাম, আমি লজ্জায় ডুবে যাচ্ছি। তবে এটি একেবারে ভিন্ন রকম অনুভূতি। একরাশ ভালোলাগাময় অনুভূতি। কেন যেন বুকের মাঝে একটু একটু সুঁড়সুঁড়ি অনুভব করতে লাগলাম। চোখটা নামিয়ে ফেললাম। মুখের হাসি যেন বাঁধ মানছে না। 
-বাব্বাহ! কী কথা! আহা, এমন লজ্জা পাচ্ছ কেন? আমি তো তোমার আপনই।
আমি ব্যাগ থেকে প্লাস্টিকের বাক্সটি বের করলাম। তিনটি গোলাপ সেখানে। আমি বের করলাম একটি। এমন সময় বেয়াড়া এসে দু'মগ কফি দিয়ে চলে গেল।
আমি বললাম, "কফি খাও আগে। এরপর বাকি কথা।"
সে হাসতে লাগলো। খিলখিল হাসি। কেমন নরম স্বরটা। কেমন মধুর। তবে তার হাসির মুগ্ধতায় ডুবে না গিয়ে এর কারণটা জিজ্ঞাসা করলাম।
: হাসছো কেন? 
- এম্নিই। 
: এত হেসো না তো। কফিটা নাও। 
এটুকু বলে আমি নিজের মগে চুমুক দিলাম। সে ছুঁয়েও দেখছে না কফিটা। আমি তখন বুঝলাম, সে আমার হাত থেকে মগটি নিতে চাইছে। স্পষ্ট আদিখ্যেতা। তবে আমার বেশ লাগলো। আমি তার মগটি হাতে নিয়ে তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। সে তখনও হাসছে। তবে মগে হাত দিচ্ছে না। 
: কী হলো, ধরো! 
- তুমি আমার হাত ধরে মগটা ধরিয়ে দাও না।
আমিও যেন চাঁদ হাতে পেলাম। তার হাতটা কখনও ধরা হয়নি। এবার হাত ধরবো। 
তার হাত ছুঁতে গেলাম। পারলাম না। তার হাতের ভেতর দিয়ে আমার হাত বেরিয়ে গেল। আমি আবার চেষ্টা করলাম। এবারও হলো না। আমার খুব আশ্চর্য লাগলো। আমি তার দিকে তাকালাম। সে আমার দিকে চেয়ে হাসছে। আমি পেছনে ঝুঁকে এলাম। বেশ অবাক হচ্ছি। 
কফি হাউসের একপাশে বিশাল কাঁচ সাঁটানো। তাতে আবছা আবছাভাবে প্রতিফলনটুকু দেখা যায়। আমি পাশ ফিরে তাকালাম। এবং দেখলাম, তাহমিনার কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। 
আমি সামনে তাকালাম। তাহমিনার সেই মুগ্ধকর হাসিমুখ। এবার আমি কিছুটা ভয় পাচ্ছি।
তবে সেই ভয় বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। আমি ওঠে গেলাম। গোলাপের বাক্সটায় হাতের গোলাপ রেখে ব্যাগে পুরে নিলাম। কফি শেষ করিনি। তবুও দাম দিয়ে ফিরে এলাম। এবং তখন একটা বিষয় বুঝলাম, কী কারণে কফির ফরমায়েশ দেয়াকালীন বেয়াড়া ছেলেটা অদ্ভুতভাবে আমার দিকে তাকিয়েছিল।
তাহমিনা বলে কেউ নেই, কেউ কখনও ছিলও না। এ সামান্য বিষয়টুকু বিশ্বাস করতে আমার বেশ কষ্ট হচ্ছিল। আমি বাসে ফিরেছি, আমার চোখে যেন নোনা জলের সমুদ্র জমে ওঠেছিল। কারো লক্ষ্যেই তা আসেনি। নাগরিক ব্যস্ততাকে আমি তাই ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম।
তাহমিনাকে আমার মনে হলো, যেন একটা জীবন্ত প্রেমকাব্য। প্রেমকাব্যের উপমাগুলো যেমন আদিখ্যেতাপূর্ণ এবং অবাস্তব হয়, তাহমিনাও তো ঠিক তেমন। একেবারে আগাগোড়া। পুরোটাই তো মিছে। পুরোটাই তো ছলনা।
হাততালির শব্দে আমার ঘোর ভাঙলো। আমি আশেপাশে তাকালাম। ওসমানের স্বরচিত লম্বাচওড়া কাব্যের আবৃত্তি শেষ হয়েছে অবশেষে। 
তানসীর হাততালি দিতে দিতে বলে ওঠলো,
"বাহ বাহ ওসমান ভাই, চমৎকার মহাকাব্য লিখেছেন। হ্যাটস অফ।"
সবাই হেসে ওঠলো। ওসমানও। সে বললো,
"লিখতে লাগছে তিন ঘণ্টা। সাড়ে বারটায় শুরু করে রাত তিনটা বিশে শেষ হইছে। কম কথা নাকি।"
আমি তাদের আনন্দে যোগ না দিয়ে ব্যাগ থেকে একটি গোলাপ বের করে হাতে নিলাম। চেয়ে থাকলাম তার দিকে। তার গভীর লাল বর্ণের দিকে চেয়ে রইলাম। টকটকে লাল বর্ণ। আঙ্গুল বুলিয়ে নিলাম তার পাপড়িতে। খুব নরম, খুব তুলতুলে, ঠিক তাহমিনার স্বরের মতই।
তাহমিনা আমায় ডাকলো,
- কাইয়ুম, এদিকে দেখো।
আমি মাথা তুলে তাকালাম। সে আমার দিকে চেয়ে আছে। তার চোখেমুখে এই প্রথম আমি বিষাদের ছায়া দেখলাম। আর তার চোখে দেখলাম এক গভীর মমতা। হয়ত সে মমতা আমার জন্যেই সে জমিয়ে রেখেছে। 
- কাইয়ুম, তুমি এমন চুপচাপ হয়ে গেলে কেন? তুমি কি আমার উপর রাগ করেছ, নাকি অভিমান করেছ? আমার উপর রাগ করাটা কি যুক্তিযুক্ত হলো? আমি তো তোমার মাঝেই আছি। তুমি যখনই চাইবে, আমি সামনে এসে পড়বো। তুমি আমাকে ভালোবাসো, আমিও তা বাসি। মূল সমস্যা হচ্ছে, এ পৃথিবীতে আমার কখনো কোনো অস্তিত্ব ছিল না, এখনও নেই। তবে সেটা তো খুব বড় সমস্যা নয়। তোমার কল্পনার সেই জগতে তো আমি জীবিত। সেই জগতে তো আমি তোমাকে ছুঁতে পারি, তুমিও তা পারো। তবে কেন এত মিছে বিষণ্ণতা? তোমার হাতের গোলাপগুলো তো আমার জন্যেই কেনা, তাই না? দাও, তুলে দাও আমার হাতে।
আমি হাতের গোলাপটা তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। আমি জানি, এবারও সে এটি ছুঁতে পারবে না। তবে সে ছুঁয়ে ফেললো গোলাপটি। আমার তর্জনীর এক অংশে আমি স্পর্শ অনুভব করলাম।
- কীরে কাইয়ুম। গোলাপ কীজন্যে দিলি? আমার জন্যে?
সম্বিত ফিরে পেতেই দেখি ওসমান হাসিমুখে গোলাপটা ধরে আছে। তার আঙ্গুলের ক্ষীণ স্পর্শ আমার তর্জনীতে লেগে আছে। 
আমি খুব দ্রুত নিজেকে গুছিয়ে হাসিমুখেই বললাম,
: গোলাপ তোর জন্যে না। বরং তোর কল্পনাশক্তির প্রখর তীব্রতার জন্যে।  
ওসমান খুশি হয়ে গেল। ঘোষণা দিয়ে দিল, সবাইকে আজ রাতের খাবারটা তার বাসাতেই খেতে হবে। আফসোস করলো রিমনের জন্যে। "শালা ইচ্ছামত প্রেম করুকগা।" বলে হাসতে লাগলো।
রাত্রিভোজনের ঘোষণা শুনে তালির বেগ বেড়ে গেল। আমি পাশে তাকালাম। তাহমিনা বসে আছে ওসমানের বিছানায়। সে হাসছে। চমৎকার সেই হাসি। আমি ভেতরে ভেতরে একমুঠো প্রেম অনুভব করলাম। তবে এরপরই দৃষ্টিটুকু ফিরিয়ে নিলাম। কার প্রতি প্রেমে পড়ছি? কল্পনাকন্যার প্রতি? আমি হেসে ওঠলাম নিজ মনেই। তালি বাজাতে লাগলাম অন্য সকলের সাথেই।
Post a Comment