১)
জহির আজই ঢাকায় ফিরল। পুরো অস্থির সময়টা মাথায় নিয়ে সে চষে বেড়িয়েছে বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্ন পল্লীতে, বিভিন্ন শহরে, বিভিন্ন দ্বারে দ্বারে। সেই অস্থির সময়ের সাময়িক অবসান গতকাল হলো। আজ ডিসেম্বরের ১৭ তারিখ, সালটা ১৯৭১। গতকাল বিকেলেই রেসকোর্স ময়দানে পাকবাহিনী তাদের হাতের অস্ত্র ফেলে দিয়ে আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ করে ফেলেছে। ছেড়ে গিয়েছে এই বাংলার ভূমি। খালি হাতে যায়নি তারা। সঙ্গে করে নিয়ে গেছে লাখো নিরীহ মানুষের প্রাণ, লাখো বাঙালী নারীর সম্ভ্রম, এবং সাথে পুরো বাঙালী জাতির এক বোঝা পরিমাণ অভিশাপ।

সেই দৃশ্য দেখার সুযোগ হয়নি জহিরের। সে এসেছে আজ সকালে, কলকাতা শহর থেকে। পুরো অস্থির সময়টার সিংহভাগ অংশই সে কাটিয়ে এসেছে ওখানে। পালিয়ে ছিল না সে, বরং ব্যস্ত ছিল এক সত্যকে তুলে ধরার অদম্য প্রয়াসে। এক সত্যকে তুলে ধরতেই তার পেছন পেছন বহু অনাকাঙ্ক্ষিত সত্য তার সামনে এসে হাজির হয়েছে। অনেক সত্য ব্যাপার তাকে বিশ্বাস করতে হয়েছে ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও। সত্য জেনেও তা পাশ কাটায়নি সে অন্য দশজনের মত। পাশ কাটানো, কিংবা আপোস করা তার স্বভাবে নেই। সে সংগ্রাম করে গেছে সেসবের স্বরূপ উদঘাটন করতে। দেশের অস্থির সময় শেষ হয়ে এলেও তার জীবনের অস্থির সময় যেন নতুনভাবে শুরু হয়ে গিয়েছে।

এদিকে দেশে ফিরে এসেও সে স্বস্তিতে নেই। এইমাত্র তার স্ত্রীর কাছে সে জানতে পারলো, বড়দা গত ১৪ তারিখ থেকেই নিখোঁজ। কেউ বলছে তাকে মেরে ফেলা হয়েছে, কেউ বলছে তাকে অপহরণ করা হয়েছে। নিশ্চিত করে কেউ কিছু বলতে পারছে না। এসব শুনে খুব শক্ত মনের মানুষ হয়েও জহির ভেঙ্গে পড়েছে। বড়দা হলেন তার একমাত্র আদর্শ। তার চিন্তাভাবনার স্বচ্ছতা এবং নিরপেক্ষতা তাকে বরাবরের মতই অনুপ্রাণিত করে যাচ্ছিল। বড়দার কাছ থেকেই তো সে অকপটে সত্য বলতে শিখেছে। আরো শিখেছে প্রকৃত অর্থেই অন্যায়ের সাথে আপোস না করার অদম্য দুঃসাহসের কঠিন পাঠ।

- জহির, কিছু অন্তত খেয়ে নাও।
জহির কাঁদছিল। তার কান্না দেখে তার স্ত্রী কিছুটা অবাক হলেও খুব বেশি হয়নি। কারণ সে নিজেও কেঁদেছে। এবং সে জানে, জহির কেন কাঁদছে।
"বলো বলো বলো ভাই! শেখ মুজিবের মুক্তি চাই! তোমার নেতা, আমার নেতা, শেখ মুজিব, শেখ মুজিব! আমার দেশ, তোমার দেশ, বাংলাদেশ, বাংলাদেশ!"
জানালা দিয়ে বাহিরের উত্তপ্ত স্লোগানগুলো ভেসে আসছিল। টেবিলে বসে থাকা জহির ওঠে গিয়ে জানালার কাছে চলে এলো। এবং সজোরে সশব্দেই জানালার দরজাগুলো বন্ধ করে দিল সে।

২)
আজকের তারিখ, ১০ই জানুয়ারি। সালটা ১৯৭২। তেজগাঁও বিমানবন্দরের সামনে অসংখ্য মানুষের ভীড়। সাহেদ আজ বিমানবন্দরে যাবে। সে থাকে নাখালপাড়ায়। বিমানবন্দর থেকে দশ মিনিটের হাঁটার পথ। সেখানেই সে থাকে সপরিবারে। আজ শেখ মুজিবুর রহমান ফিরবেন ভারত থেকে। তিনি মুক্তি পেয়েছেন। আজ সারা বাঙালি তাঁকে বরণ করে নিবে। সারা বাঙালি জাতি এতদিন ছিল তাঁর আগমনের আশায়। পুরো অস্থির সময়টায় তিনি ছিলেন অনুপস্থিত। তাঁকে যে গত বছরের মার্চের পঁচিশের রাতেই গ্রেফতার করে নিয়ে নেয়া হয়েছিল করাচির কারাগারে।

সবাই উৎকণ্ঠিত ছিল। না জানি সেই শুয়োরের বাচ্চারা আমাদের শেখ মুজিবকে কতই না অত্যাচারে জর্জর করেছে। শেখ মুজিব ভালো ছিলেন তো? অস্থির সময়টায় একবার গুজব ছড়িয়েছিল একদল কুকুর। তারা বলেছিল, শেখ মুজিবকে নাকি মেরে ফেলা হয়েছে। চুনকালি পড়ুক তাদের মুখে। আজ আমাদের শেখ মুজিব ফিরে এসেছে বাঙালির কাছে, তাঁর মায়ের কোলে।

প্রচুর মানুষের ভীড় তেজগাঁও বিমানবন্দরে। ভেতরে যাওয়ার উপায় নেই। সাধারণ মানুষের এত ভীড় বিমানবন্দরে এর আগে দেখা যায়নি। তবে আজ উপলক্ষ্য ভিন্ন। আজ শেখ মুজিব আসবে।
সাহেদ আজ এসেছে শুধু শেখ মুজিবকে এক নজর দেখতে। তবে যা অবস্থা দেখা যাচ্ছে, হয়ত তার এ আশা পূরণ হবে না। এত ভীড়, সাহেদ আগেও কখনো দেখিনি, পরেও হয়ত কখনো দেখবে না।

সাহেদ আসতে বেশ দেরী করে ফেলেছিল। ততক্ষণে শেখ মুজিব এসে পৌঁছে মঞ্চে ওঠে বক্তৃতা দিতে শুরু করেছেন। অনেক কথাই তিনি বললেন, কিছু কথা সাহেদের কানে গেল,
"কবিগুরু বলেছিলেন, 'সাত কোটি বাঙালির হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে,  মানুষ করোনি।' কবিগুরুর সেই কথা আজ মিথ্যে প্রমাণিত হয়ে গেছে, আমার বাঙালি আজ মানুষ।"....
"আমার বাঙালি আজ স্বাধীন হয়েছে, আমার জীবনের সাধ আজ পূর্ণ হয়েছে, আমার বাংলাদেশ আজ মুক্ত হয়েছে।"

শেখ মুজিবের সেই চিরচেনা কণ্ঠ, সেই চিরচেনা বক্তব্যের প্রশস্ততা, সেই গুছিয়ে কথা বলার দৃঢ়তা, সাহেদকে আবারও মুগ্ধ করলো।

শেখ মুজিব এসে পড়েছে। আর কোনো ভয় নেই। আর কোনো হতাশা নেই। কোটি বাঙালির মত সাহেদও আশায় আছে, এই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটাকে শেখ মুজিব আবারও গড়ে তুলবে। বিচার হবে সকল দুষ্কৃতিকারীর। শান্তি ফিরে আসবে সকল বাঙালির মাঝে।


৩)
জহির বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে। তার এ বিভ্রান্তির শুরুটা হয়েছিল গত বছরের (১৯৭১) এপ্রিল মাস থেকেই। কলকাতায় ছিল সে। ব্যক্তিগত জীবন থেকে বিদায় নেয়া জহির নিজের সবচেয়ে ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র 'জীবন থেকে নেয়া'র প্রদর্শনী করেই প্রচুর অর্থ হাতে পেল। তবে পাঠাল না পরিবারের কাছে। বরং পাঠিয়ে দিল মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরে।

সেখানে থেকেই তাঁর মাথায় এসেছিল একটি তথ্যচিত্র নির্মাণের। বাংলাদেশে থাকা বিদেশি সাংবাদিকেরা দেশের মধ্যে বিরাজ করা গৃহযুদ্ধের সঠিক চিত্রটি তুলে ধরতে পারছিলেন না বিশ্বদরবারে। অনেক তথ্য পাকিস্তান সামরিক সরকারের দমনে আটকে যাচ্ছিল। তাই জহির সে সময়ে ঠিক করে ফেললো, যে করেই হোক, একটা তথ্যচিত্র নির্মাণ করবেই। নাম ঠিক করে দেয়া হয়েছিল, "Stop Genocide"। 'গণহত্যা থামাও'। বন্ধুপ্রতিম চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবির ছিলেন এর ধারাভাষ্যকার।

সেটি তৈরি করতে গিয়ে জহির অনেক অনেক নগ্ন সত্য আবিষ্কার করে ফেলেছিল। কলকাতায় থাকা প্রবাসী সরকারের মন্ত্রীবর্গ ও বাংলাদেশের একটি বিশেষ লীগের নেতারা কেমন দেশের সেবা করছিলেন, তার কিছু নমুনা জহির সে সময়ে পেয়ে গিয়েছিল।

জহির গিয়েছিল কলকাতার কিছু শরণার্থী শিবিরে, তথ্যচিত্রের শ্যুটিং-এর জন্যে। কিন্তু সেখানে সে বাধা পায়। কিছু কিছু জায়গায় শ্যুটিং-এর জন্যে তাকে যেতেও নিষেধ করা হয়। উড়োউড়ো হুমকিও তার কানে আসে। এবং এতসব বাধা আসে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলটি থেকেই, যারা নাকি মুক্তিযুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন।

'Stop Genocide' বাধা পায়। একে প্রচার করতে ও ছাড়পত্র দিতে পাকিস্তান সামরিক সরকারের পাশাপাশি প্রবাসী সরকারও বাধ সাধে। প্রবাসী সরকারের আপত্তিটুকু জহিরের কাছে পরিহাসের মত ঠেকেছিল সে সময়ে।
সেপ্টেম্বর মাসে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সেন্সর বোর্ডের কাছে চলচ্চিত্রকার ফজলুল হক একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন, যেখানে তিনি আপত্তি হিসেবে তুলে ধরেছিলেন এই অংশটি;
"...The film start with a photo of V.I LENIN and with his wordings; shows nothing but little of refugees in India and a little part of our liberation army training camp. But the serious set back is, in my opinion, that there is not a single shot or word about our beloved leader Bangabandhu Sheik Mujibur Rahman or Awami League or Six points. If the film had been made by any Indian Director, we shall reserve our comments, but when it is made by a director of Bangladesh, we can not sit idle. I, personally, protest against this film and I request you to take immediate action to stop this film before it is shown to the public through the Indian Government.
If it is not done, I alone am ready to start a movement."
.
...এবং বলা বাহুল্য, জনাব ফজলুল হক নিজে ছিলেন সেই বিশেষ রাজনৈতিক গোষ্ঠীর কট্টর সমর্থক। এবং তিনি তখন ছিলেন কলকাতায়, তাদেরই নিরাপত্তার বেষ্টনীর মাঝে।

জহিরের মনে পড়ে গেল ১৯৭০ সালের এপ্রিলের কথা। 'জীবন থেকে নেয়া' সিনেমার ছাড়পত্র দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছিলেন তৎকালীন পাকিস্তান সামরিক সরকার। আপত্তি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানীবাসীরও। অথচ দু'পাকিস্তানের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্রকার হিসেবে জহির দু'পাকিস্তানের জনগণ ও চলচ্চিত্রকারের নিকট ছিলেন সমাদৃত ও সম্মানের অধিকারী। তারাই আটকে দিলেন 'জীবন থেকে নেয়া'র শুরুর পথচলা। বন্ধুপ্রতিম আমজাদ হোসেনকে দিয়ে জহির অনুরোধ করিয়েছিল, যেন ছাড়পত্রটুকু দিয়ে দেয়া হয়। তারা জানিয়েছিলেন, চলচ্চিত্রটি স্বয়ং রাও ফরমান আলী নিজের চোখে দেখবেন, এবং এরপর মতামত জানাবেন।

ওদিকে তখন পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনগণ রাস্তায় নেমে পড়লো। তাঁদের দাবী, 'জীবন থেকে নেয়া'কে যেন বাধা না দেয়া হয়। সফল চলচ্চিত্রকার হিসেবে তখন জহিরের অনেক নামডাক ছিলই। সেই যুক্তিতে সাধারণ জনগণ বুঝে নিয়েছিল, এই চলচ্চিত্রে তাঁদের অধিকারের কথা অবশ্যই অবশ্যই বলা হয়েছে।

রাও ফরমান আলী চলচ্চিত্রটুকু দেখেছিলেন ইংরেজি সাবটাইটেলসহ। দেখার পর তিনি স্তব্ধ হয়ে বসেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি একে ছাড়পত্র দেন। তবে জহিরকে সামনে পেয়ে তিনি বলেছিলেন, "এবার ছেড়ে দিচ্ছি। But I will see you later."

যেন সেই রাও ফরমান আলীর উত্তরসূরিরাই আজ 'স্টপ জেনোসাইড'কে আটকে দিচ্ছে, এক হাস্যকর অজুহাতকে দাঁড় করিয়ে। এই দেশ আর এই সংগ্রাম কি শুধু একজন নেতার, শুধু একটি দলেরই?
জহির জানুয়ারির শুরুর দিকেই বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রকৃত স্বরূপ উদঘাটনের জন্যে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। বুদ্ধিজীবীরা কাদের বলির শিকার, সেটি তিনি বের করতে চেষ্টা করেন।

তাঁদের কি কতিপয় রাজাকার বাহিনীরাই হত্যা করেছিল, নাকি রাজনৈতিক মতের অমিল থাকায় এদেশের বৃহৎ লীগটি তাঁদের সরিয়ে দিয়েছিল? জহির চিন্তায় পড়ে গেল। কিছু বুদ্ধিজীবীদের নিঃসন্দেহে রাজাকারেরাই ওঠিয়ে নিয়ে গেছে, এবং পাকিস্তানী মিলিটারি কর্তৃকই তাঁরা হত্যার শিকার হয়েছেন। তবে অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর মত বুদ্ধিজীবীদের বেলায় এই কারণটিকেই পুরোপুরি নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।

জহির বেশ ভালোভাবেই জানে, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী কমিউনিস্ট পার্টির ঘোর সমর্থক ছিলেন। এবং কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থকেরা অখণ্ড পাকিস্তান চাইতেন। এবং ঠিক এ কারণেই কমিউনিস্ট পার্টির সাথে এদেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দলটির বেশ বড় ধরনের বিরোধ ছিল। মুনীর চৌধুরীও এদের বাইরে ছিলেন বলে জহিরের মনে হয় না।

জহির নিজে কমিউনিজমের অনুসারী, এমনকি তাঁর বড়দা শহীদুল্লা কায়সারও। তবে দেশের দুঃসময়ে দল বা মতাদর্শকে বড় করে দেখাটা সুবিবেচকের কাজ নয়।

সাধারণ জনগণ রাজনীতির জটিল মারপ্যাঁচ বোঝেন না। তাঁরা অতশত বুঝতেও চান না। তাঁরা শুধু চান শান্তি, সুবিচার এবং সুনাগরিকের অধিকার। তাঁদের জন্যে কাজ করতেই, এবং বিবেকের কাছে দায়মুক্ত থাকতেই নিজের মতাদর্শের বিপক্ষে গিয়ে জহির মুক্তিযুদ্ধের পেছনে ঢেলেছিল নিজের সমস্ত অবদান। রক্তকে করেছিল পানি।

তবে আজ সে বিভ্রান্ত। আসলেই বিভ্রান্ত। যারা নিজেদের স্বাধীনতার প্রবক্তা বলে দাবী করছেন, তারা কি আসলেই স্বাধীনতা চেয়েছিলেন? যদি চেয়েই থাকেন, তবে কেন তারা কলকাতায় পালিয়ে ছিলেন? কেন তারা সেখানে বিলাসবহুল হোটেলে আর কিছু বিশেষ পাড়ায় আমোদ-ফূর্তি করে বেড়িয়েছিলেন? কেন তারা অতি নিকটের শরণার্থী শিবিরগুলোতে একটিবারের জন্যেও পরিদর্শন করে আসেননি?

জহিরের কাছে তথ্য ছিল। প্রামাণিক তথ্য। অজস্র ভিডিও ফুটেজ এবং অজস্র পেপার ডকুমেন্টস। সে বুদ্ধিজীবীদের হত্যার রহস্যের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এই বিশেষ দলটির অনেক গোমর ফাঁস করে দিবেই। তবে সে এখনও কাউকে জানায়নি। এবং মানসিকভাবেও সে বেশ বিধ্বস্ত। কারণ বড়দাকে এখনও পাওয়া যায়নি।


৪) 
জানুয়ারির ২৫ তারিখ চলে এলো, ১৯৭২ সালেরই। মঙ্গলবার। জহির কিছুদিনের জন্যে ভারতের আজমীর শরীফে ছিল। রফিক নামের তার এক শুভাকাঙ্ক্ষী তাকে জানিয়েছিল, "আজমীর শরীফে গিয়ে বাবার কাছে কেউ কিছু চাইলে তারা খালি হাতে ফিরে আসে না।"

ছাত্রজীবন থেকেই ধর্মকর্মের প্রতি জহিরের বিতৃষ্ণা ছিল। বেশিরভাগ মাজারকেই সে ভণ্ডজ্ঞান করত। তবে আজ সে ডুবন্ত ব্যক্তি। এবং ডুবন্ত ব্যক্তি প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে খড়কুটো পর্যন্ত আঁকড়ে ধরে। আজমীর শরীফে যাওয়াটাও তার খড়কুটো আঁকড়ে ধরারই একটা নমুনামাত্র। সেখানে সে কিছুদিন কাটিয়ে এসেছে। তার একটাই আকুতি ছিল সেই বাবার কাছে। তার বড়দা যেন ফিরে আসে তাদের মাঝে।

ঢাকায় ফিরেই সে একটা প্রেস কনফারেন্সের আয়োজন করলো। প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণেই। অসংখ্য পত্রপত্রিকার সাংবাদিকদের সামনে সে বেশকিছু তথ্য দিল,
"আপনাদের এই কনফারেন্সে এমনিএমনি ডাকা হয়নি। বুদ্ধিজীবী হত্যার কোনো কুলকিনারা আজো হয়নি। আমাদের মহামান্য নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ফিরে এসেছেন, সেটা বেশ আশাপ্রদ হতে পারত। তবে একে ঠিক আশাব্যঞ্জক বলে অন্তত আমি মনে করছি না। কারণ, তিনি বুদ্ধিজীবী হত্যার কোনো প্রকারের বিচারের উদ্যোগে এখনও যাননি। গত ডিসেম্বরের শেষদিকে আমার বড়দা শহীদুল্লা কায়সারের অপহরণকারী রাজাকার বাহিনী আল-বদরের নেতা এ.বি.এম খালেক মজুমদারকে গ্রেফতার করা হলেও এই অল্প কিছুদিন আগে শেখ সাহেব তাকে মুক্তি দিয়ে দিলেন। এমনটা তিনি কেন করলেন? আমাদের কি এসব ভাবায় না?

বুঝলাম নতুন দেশ, নতুন সরকার। তবে শেখ মুজিব দেশে ফিরেছেন, আজ পনের দিন পেরিয়ে গেল। এখনও কি উনি কাজ গুছিয়ে নিতে পারেননি? তাঁর বিষয়ে আমাদের মাঝে কিছু বিরূপ ধারণা ভুল করে এসেই যাচ্ছে। একে কি আমরা অমূলক বলতে পারি? অবশ্যই না।

জানুয়ারির শুরুতেই তাই আমি ও আমার মত যাঁরা কাছের মানুষদের হারিয়েছেন, তাঁরা একত্র হয়ে বুদ্ধিজীবী হত্যার তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। আমরা চেষ্টা করছি এর পেছনের রহস্যগুলো উদ্ধার করতে। অনেক তথ্য বেরিয়েও এসেছে। আর এছাড়াও আমার হাতে আরো বেশ কিছু অপ্রিয় তথ্যাদি রয়েছে, যা মুক্তিযুদ্ধকালীন আমার হাতে এসে পৌঁছেছিল কলকাতায় যখন ছিলাম। অনেক ভিডিও ফুটেজ ও ছবি, সাথে নথিপত্রও রয়েছে। এসব প্রকাশ করলে আপনাদের চোখে সম্মানের পাত্র অনেক নেতারই গোমর ফাঁস হয়ে যাবে।

তাই আগামী ৩০শে জানুয়ারি, রোজ রোববার, ছুটির দিনেই এই প্রেসক্লাবেই আমি সেসব ডকুমেন্টস আপনাদের সামনে তুলে ধরবো। আমি সত্যের অনুসারী। আমি কখনও অন্যায়ের সাথে আপোসকারীদের দলে ছিলাম না। আর আশা করি সামনের দিনগুলোতেও আমি আমার কর্ম ও বিশ্বাসের উপর সৎ থাকবো।

সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ।"

৫) 
টেলিফোনটা বেজে ওঠলো। সুরাইয়া ফোনটা ধরতে ছুটে গেল। জহিরের প্রথম পক্ষের স্ত্রীর ছোট বোন সে। অনলের খালা। সে ফোনটা তুলে নিল। ওপাশ থেকে কণ্ঠ ভেসে আসলো, "জহির রায়হান কোথায়? তাঁকে দিন তো একটু কষ্ট করে।"

জহিরকে সুরাইয়া ডেকে দিল। জহির রিসিভার কানে রেখে কণ্ঠটা শুনেই চিনতে পারল। ওপাশ থেকে রফিক কথা বলছে। সেই রফিক, যার অনুরোধে সে আজমীর শরীফে কয়েকটা দিন থেকে এসেছিল।
-"জহির সাহেব, আপনার বড়দার খবর পাওয়া গেছে। তাঁকে উদ্ধার করে আনতে চান?"

জহিরের ভেতরটা যেন কেঁপে ওঠলো।
একেবারে শান্ত-নিবিড় হয়ে সে জবাব দিল দু'টো শব্দে, "হ্যাঁ, চাই।"

রফিক বলল, "তাহলে এখনই মিরপুর-১২ নং-এ চলে আসুন। এদিকে উনি বন্দি আছেন। একাই আসবেন। সাথে আর কাউকে আনলে সমস্যা হতে পারে।"

জহির আর কিছু চিন্তা করার প্রয়োজন মনে করেনি। দ্রুত তৈরি হয়ে নিল সে। শার্ট-প্যান্ট পরল, পায়ে মোজা পরল। ভারতীয় এক ব্রিগেডিয়ারকে ফোন করলো সে। সেই ব্রিগেডিয়ার সাহেবের ক্ষমতা তাঁর কাজে লাগবে। মিরপুর ১২ নং এখন ভারতীয়-বাংলাদেশী সেনাবাহিনীর যৌথ উদ্যোগে অবরুদ্ধ
বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে স্ত্রী সুচন্দা, শ্যালিকা ববিতা আর ছোট্ট চম্পাকে ডেকে আনলো সে।
-"তোমরা আজ একটু নামাজ-কালাম পড়ে দোয়া কোরো। আমি ফিরে এসে তোমাদের সবাইকে চমকে দেব।"

ববিতার অনুভূতি মিশ্র ছিল। আনন্দ আর ভয়, দু'টোই কাজ করছিল তার মাঝে। কারণ, সে জানে আজ বিকেলটা জহির ভাইয়ের জন্যে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। ভারতে বসে প্রবাসী সরকারের ভেতরে লুকিয়ে থাকা বিশ্বাসঘাতকদের বিরুদ্ধে যা যা প্রমাণ জহির ভাই জোগাড় করেছিল, আজ বিকেলে সেগুলো প্রকাশ পাবে। সবকিছুই প্রস্তুত। আজ ৩০শে জানুয়ারি, রোববার।

তবে সকাল আটটায় যখন ফোন এলো, তখন থেকেই জহির ভাই যেন একেবারে শান্ত হয়ে পড়ল। যাওয়ার আগে বলল, তাদের নাকি চমকে দিবে।

ববিতা একটু পরেই ভারতীয় সেই ব্রিগেডিয়ারকে ফোন করল। সেই ব্রিগেডিয়ার আজ রাতের ডিনারটা জহির, ববিতাসহ পুরো পরিবারকে নিজের বাড়িতে করার দাওয়াত দিয়ে দিলেন। সেলিব্রেশন হবে। বিকেলে সবার গোমর ফাঁস করে দেয়ার আনন্দে সেলিব্রেশন। বাংলাদেশের বিশ্বাসঘাতকদের সামনে নিয়ে আনার আনন্দে সেলিব্রেশন।

জহির অবশ্য একা বেরোয়নি। সাথে বেরিয়েছেন ছোট ভাই জাকারিয়া হাবিব, চাচাত ভাই শাহরিয়ার কবির, বাবুল (সুচন্দার ভাই), আব্দুল হক (পান্না কায়সারের ভাই), নিজাম ও পারভেজ।

কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয়, বেলা ১১টা বাজতেই তারা সবাই বাসায় ফিরে আসলেন, শুধু জহির ছাড়া। তারা বাসার সকলকে জানায়, মিরপুর ২নং সেকশনে পৌঁছানোর পর সেখানে অবস্থানরত ভারতীয় সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী (ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট) এবং পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে জহিরকে টয়োটা গাড়িসহ থাকতে বলে। এবং তাঁদের ফেরত পাঠিয়ে দেন।

সবাই অপেক্ষা করতে লাগলেন। জহিরের প্রথম স্ত্রী নিলুফার, দ্বিতীয় স্ত্রী সুচন্দা, শ্যালিকা ববিতা, সুরাইয়াসহ সকলেই অপেক্ষা করতে লাগলেন।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামলো। বিকেল সন্ধ্যার পথ ধরে রাত বেয়ে আরো গভীরে চলে গেল। হাজারো শুভানুধ্যায়ী অপেক্ষায় রইলেন।

বিকেলবেলাটায় প্রেসক্লাবেও জমেছিল প্রচুর মানুষের ভীড়। হতাশ হলো সবাই। অনেকে গালাগাল করতে লাগলো। অনেকে নানান কথা বলতে লাগলো।

দিনটি কেটে গেল। এরপর অপেক্ষায় রইলেন দেশের কোটি কোটি মানুষ।

সেই অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো না। বেশিরভাগ মানুষই ধারণা করতে লাগলেন, জহির নিখোঁজ হয়েছে। অনেকে এই ঘটনাকে অনেক ষড়যন্ত্রের মধ্যে সংযুক্ত করার চেষ্টাও করলেন। প্রকৃত সত্য ঘটনাটি কী ছিল, তা আর কেউ জানতেও পারলেন না।

পরিশিষ্ট
১৯৯২ সাল। 'শেষ বিকেলের মেয়ে' উপন্যাসটি শেষ করে ছলছল চোখে বারান্দায় দাঁড়ালো বিশ বছর বয়েসী তাউসিফ।
১৯৯৫ সাল। 'হাজার বছর ধরে' উপন্যাসটি পড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো পঁচিশ বছর বয়েসী যাইনাব।
১৯৯৭ সাল। 'বরফ গলা নদী' উপন্যাসটা পড়া শুরু করলো একুশ বছর বয়েসী ইমতু।
১৯৯৯ সাল। মিরপুর ১২ নং-এ বাবার লাশের অবশিষ্টাংশ ধরে নিয়ে বাবার মৃত্যুকে নিশ্চিত করলো অনল রায়হান।
২০১২ সাল। টেলিভিশনে 'জীবন থেকে নেয়া' চলচ্চিত্র থেকে ভেসে আসছে খান আতাউরের গাওয়া সেই গান, "এ খাঁচা ভাঙবো আমি কেমন করে?"
২০১৫ সাল। ২২ বছর বয়েসী এঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র জহির রায়হানকে নিয়ে লিখতে বসলো একটি উপন্যাস।
২০১৮ সাল। 'স্বাধীনতা দিবস' উপলক্ষে আয়োজিত একটি গ্রুপের ইভেন্টে গল্প লেখার জন্যে সব ব্যস্ততা ছেড়ে 'ভগ্নকণ্ঠ' নামক গল্পটি লিখতে বসলো একুশ বছর বয়েসী এক গল্পকার।

'স্বাধীনতা' খুঁজে ফিরি।
'স্বাধীনতা' কখনও ছিল কী?
স্বাধীনতা যদি থাকত, আজ জহিরও বেঁচে থাকত।

জহির আজ শুধু চলচ্চিত্রকার ও সাহিত্যিক হিসেবেই আমাদের মাঝে বেঁচে আছে। অথচ সে যে ব্যোমকেশ বক্সীর মত একজন প্রকৃত অর্থের 'সত্যান্বেষী' ছিল, সে কথা আমরা অনেকেই হয়ত জানি না। অথবা জেনেও না জানার ভান করে আছি।

স্বাধীনতার কথা বলে বলে আজ আমাদের কণ্ঠটা ভেঙ্গে গেছে।
এই ভগ্নকণ্ঠ নিয়েই বলছি, দেশটা আজো স্বাধীন হয়নি জহির। তুমি হারিয়ে গিয়ে এক অর্থে বেঁচেই গিয়েছ।


সহায়ক সূত্রসমূহ :
আগুনের দিন শেষ হয়নি। [কিশোর পাশা ইমন, হৃদি প্রকাশ]
• ‎চিঠির সূত্র : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস ও দলিলপত্র (৩য় খণ্ড, পাতা ১২৭-১২৮), তথ্য মন্ত্রণালয়, গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। প্রথম প্রকাশ - নভেম্বর ১৯৮২।]
• গল্পগ্রন্থ : ‎একুশে ফেব্রুয়ারী / জহির রায়হান  (বইটির ভূমিকা : শাহরিয়ার কবির) [পল্লব পাবলিশার্স; আগস্ট, ১৯৯২]
• ‎নির্মল সেন / আমার জবানবন্দি [ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ-ফেব্রুয়ারি, ২০১২। পৃ: ৪০৫-৪০৬ ]
• ‎অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা - মেজর এম. এ জলিল।
• ‎Stop Genocide (জহির রায়হান নির্মিত গণহত্যাভিত্তিক তথ্যচিত্র)

Post a Comment

Previous Post Next Post