রেলিংবিহীন ছাদের একেবারে পূর্বকোণে দাঁড়িয়ে পূর্বের আঁধারে ডুবে যাওয়া গাছগুলোর গাঢ়, নিস্তব্ধ অবয়বের দিকেই তাকিয়ে আছি। গাঢ় কৃষ্ণবর্ণে বর্ণিত হয়ে সেগুলো নিজেদের অস্তিত্বের মাঝে একটি রহস্যময়ীতা তৈরি করে নিয়েছে। সেই রহস্য শুধু নিজের অস্তিত্বেই আবদ্ধ থাকেনি, বরং তার চারপাশে স্নিগ্ধ পবনের সাথেই সেগুলো ছড়িয়ে পড়েছে।

দক্ষিণ-পূর্ব, এবং উত্তর-পশ্চিমদিক হতে আযানের সুললিত কণ্ঠের সুর ভেসে আসছে। সকলকে কল্যাণের দিকে, একত্ববাদিতার দিকে আহ্বান করে যাচ্ছেন দায়িত্বশীল মুয়াজ্জিন। আকাশে তারা থাকলেও চাঁদ নেই। তাই নিগূঢ় আঁধার কেটে যাবে, সেই সম্ভাবনাটুকুও নেই।
.
গ্রামের দিকটাতেই থাকি। মফঃস্বল নয়, তবে হয়ত বছর পাঁচেকের মধ্যে এটি মফঃস্বলতার রূপ ধারণ করে নিবে। তবে আমি সেটি চাই না। কারণ মফঃস্বলে ভোরের স্নিগ্ধ সৌন্দর্য, এবং রাতের রহস্যময়ীতা অবলোকন করার সুযোগটা পাওয়া যায় না। ইট-পাথরের দালানের মাঝ দিয়ে সূর্য ওঠে-নামে; সেটির পৃথক সৌন্দর্য হয়ত আছে, তবে সেটি কৃত্রিমতার মোড়কে আবৃত। পূর্বদিককার অজস্র গাছগাছালির পাতা ভেদ করে, অজস্র পাখপাখালির আহ্বানে সাড়া দিয়ে যে সূর্য উঠে; এবং যথাসময়ে পশ্চিমের সমুদ্রের মাঝে লালচে বর্ণ ধারণ করে সেটি যে সৌন্দর্যময়ীতার আবরণে নিজেকে ঢেকে নিয়ে নেমে পড়ে; এমন স্রষ্টাপ্রদত্ত সৌন্দর্য শুধু সমুদ্রতটের গ্রামগুলোয় অবলোকন করা সম্ভব। তবে এই সৌন্দর্যের দিকে সভ্যতা আমার মত চেয়ে থাকবে না। সে এগিয়ে যাবে। এবং গেড়ে যাবে তার কৃত্রিমতার খুঁটিগুলো।
.
আমার মত একটি সামান্য মেয়ে তো কখনও প্রকৃতির সুধা পান করতে চায়নি। তাহলে আজ হঠাৎ আমার কী হলো যে, রাতের বেলায় ছাদে ওঠে প্রকৃতির সৌন্দর্য বিচারে একেবারে নেমে বা উঠে পড়েছি। শুধু 'নেমে পড়েছি' বলতে চাইছি না, কারণ সৌন্দর্যে বিচার তো নেমে পড়ার মত গর্হিত কাজের আওতায় পড়ে না। আবার শুধু 'উঠে পড়েছি'ও বলতে চাইছি না, কারণ আমার মত সামান্য মেয়ের মাঝে প্রকৃতির সৌন্দর্য বিচার করার যথাযথ যোগ্যতা নেই।

সত্যি কথা বলতে, ঠিক সৌন্দর্য বিচারের খেয়ালিপনায় ডুবে পড়তে ছাদে ওঠিনি। ওঠেছি ভিন্ন এক কারণে। যার বর্ণনায় বাস্তব্য হয়ে ওঠবে কিছু কল্পবিলাসী মন।
.
ভার্সিটির অন্য সকল সহপাঠিনীর মত করেই একটি চিরকুট আমার খাতার মাঝে আমি একদিন আবিষ্কার করি। রঙিন পাতার চিরকুট। সবুজ রঙের ছিল কাগজের টুকরোটি। এবং তার মাঝে লিখে নেয়া অজস্র শব্দের সম্মিলনে তৈরি অজস্র বাক্যের সাজসজ্জার একটিই সর্বজনজ্ঞাত সারাংশ ছিল, "তোমাকে ভালোবাসি।"

ভালোবাসার কাঙাল কিন্তু সবাই। একেবারে সবাই-ই। কোনো মানুষ তার স্বীকারোক্তির থলের মাঝে কখনোই লুকিয়ে রাখবে না তার মাঝে লুকিয়ে থাকা ভালোবাসার কাঙালিপনার বিরহের কথা। মৌলিক চাহিদার পরে ভালোবাসার চাহিদাও মানুষকে খুব করে ক্ষুধাতুর করে তোলে।

আমার মতে 'ভালোবাসা' ঠিক অন্যকিছু। আমার সংজ্ঞার সাথে অন্যদের সংজ্ঞা চেহারার মতই ভিন্নতা পাবে। ভালোবাসা আসে শ্রদ্ধাবোধ থেকে, সহযোগিতা থেকে। এবং ভালোবাসা হচ্ছে এমন এক ব্যাপার, যাকে আমরা ভালোবাসি, তার কল্যাণের জন্যেই সবসময় আমরা প্রার্থনা করে যাই; চাই সে আমাকে ভালোবাসুক আর না-ই বাসুক।

হাল আমলের 'Love at first sight' এ কারণেই আমার কাছে খুবই ঠুনকো বিষয়। প্রথম দেখাতেই কেউ কাউকে ভালোবেসে ফেলে না। এটি কল্পনার জগতে যতটুকু বাস্তব, বাস্তব জগতে ততটুকুই কল্পনা। ভালোবাসা প্রথম দেখাতেই বেড়ে ওঠে না। তাছাড়া 'Love at first sight' ব্যাপারটি কিন্তু বাবা-মা, ভাই-বোন, কিংবা বন্ধুদের সাথে ঠিক হয় না। এটি তখনই হয়, যখন একটি ছেলে আরেকটি মেয়েকে কামনার দৃষ্টিতে দেখে। স্বীকার করুক, আর না-ই করুক; প্রতিটা ছেলের মাঝেই এই কামনার চোখটি আছে। তারা সেই চোখ দিয়েই তাদের সমবয়েসী প্রতিবেশী-কন্যা, ক্লাসমেট, সহকর্মী, কিংবা কিছুক্ষেত্রে ট্যুইশনির ছাত্রীদের দিকে দৃষ্টি ফেলে। পার্থক্য হলো, কারো দৃষ্টি উগ্র, আর কারোটা লঘু। তবে দৃষ্টিটা যে সব ছেলেরই আছে, এটা আমি বেশ ভালোই জানি।
.
তখন আমি ক্লাস নাইনে ওঠেছি সবে। বড় ভাইয়া তাঁর এক বন্ধুকে ঠিক করে দিলেন আমাকে পড়াবার জন্যে। ভাইয়াটার নাম ছিল কিংশুক। তবে আমি তাঁকে 'স্যার' সম্বোধনেই সম্বোধিত করতাম।
তিনি বেশ ভালো পড়াতেন। অনেক সময় মজা করে পড়াতেন। পড়ার মাঝে এমনসব কৌতুক শোনাতেন, যা আমি কখনও শুনিনি, তবে শোনার পর হাসি আটকে রাখতে পারিনি। তাই তিনি পড়াতে আসলে আমার বেশ আনন্দই লাগত।

তাঁর প্রতি কৌতুকে হাসতাম, প্রতি পড়ার ব্যাখ্যায় মুগ্ধদৃষ্টিতে চেয়ে থাকতাম, প্রতিবার তিনি চশমা খুলে সামনে রাখলে তাঁর চোখের দিকে চেয়ে থাকতাম। তাই বেচারা স্যার ভেবেছিলেন, আমি তাঁর প্রেমে পড়ে গেছি।

অবশ্য পড়ানোর মাঝে, বা আমাকে কিছু লিখতে দেয়ার মাঝে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে থাকতেন। একবার তাঁকে মুখে মুখে পড়া দেয়ার সময় লক্ষ্য করলাম, ওড়না দিয়ে ঢেকে রাখা সত্ত্বেও তিনি আমার বুকের দিকে সেই পুরুষালি দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছেন। সেদিন আমি বেশ লজ্জা পেলাম, যদিও লজ্জাটি তাঁর পাওয়া উচিত ছিল।
.
একদিন তিনি আমাকে রসায়ন পড়াচ্ছিলেন। সেদিন পরীক্ষা নেয়ার কথা ছিল, তাই আমার পরীক্ষার জন্যে বরাদ্দকৃত খাতায় তিনি প্রশ্ন লিখতে লাগলেন। আমার দিকে খাতাটি এগিয়ে দিলেন তিনি। আমি প্রশ্নে চোখ বুলিয়ে মনে মনে পড়তে লাগলাম,

"হ্যালোজেন কী? এর রাসায়নিক সংকেত তুলে ধর। (মার্ক ৩)
কনক, আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি কি আমায় ভালোবাসো? ভালোবেসে থাকলে এই লেখার পাশে 'হ্যাঁ' লিখে দিও।"
.
বাদুড় উড়ে গেল মাথার উপর দিয়ে। তার গন্তব্য, পূর্বদিক। আমি ফিরে এলাম আমার বর্তমানে, আমার বাসার ছাদের কোণে। আমার দৃষ্টি নিবদ্ধ এখনও সেই আঁধারে ঘেরা গাছগুলোর দিকে। আমি ওসবের দিকে চেয়ে আসলে খুঁজছিটা কী! আমি কিছুই খুঁজছি না আসলে। আমি শুধু চেয়ে আছি। একে উদ্দেশ্যহীন দৃষ্টিও বলবো না। মানুষ তার মনের যাবতীয় বিষাদ অনুভব করতে যেভাবে শূন্যে দৃষ্টি ফেলে রাখে, আমিও এই অনুভবনীয় মুহূর্তে এমন দৃষ্টি ফেলছি। তাই হয়ত মনে হচ্ছে, আমি গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে আছি। আসলে আমি তাকিয়ে আছি আমার অতীতের দিকে। চোখের সামনে তো সেটিই ভাসছে।
.
আমি তাঁর প্রশ্নের উত্তরে হ্যাঁ কি না বলেছি, তা বলবো না। তাছাড়া আমার উত্তর কীরূপ হয়েছিল, তা জানার প্রবল আগ্রহ যাদের হচ্ছে, তাদের উদ্দেশ্যে একটাই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। সেটি হলো, এরকম মুহূর্তে একটা মেয়ে কী করে এর উত্তর দেবে, যখন সে এমন চিন্তাভাবনা মাথাতেই আনেনি।
চাপিয়ে দেয়া কেন? আমি কি আমার সেই স্যারকে, বা স্পষ্টতায় তুলে ধরে বললে, কিংশুক ভাইয়াকে কখনও সেই দৃষ্টিতে দেখেছি? অবশ্যই না। আমার মধ্যে আর দশটা মেয়ের মত এমন অবিবেচকের অবিবেচনাজাত সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রবণতা ছিল না। বরং আমি সেই দশজন মেয়ের দলে ছিলাম, যারা স্বাভাবিকতার প্রবাহে নিজের সমস্ত অস্তিত্বের নৌকোটাকে ভাসিয়ে নিয়ে চলে। আমি ঠিক সেই মুহূর্তে এমন ভালোবাসাবাসি, কাছে আসা-আসি ধরনের কল্পনারসে ডুবে থাকতাম না। আমার হাতের সামনে ছিল বই, চোখের সামনে ছিল পরিকল্পনা, মননে-মগজে ছিল স্বপ্ন, প্রত্যয়ে ছিল পরিশ্রমসাধ্যতার সামর্থ্যতা।
.
আমি এড়িয়ে গিয়েছিলাম। তবে এখানে সমস্যা হলো, উনি আমার বাসায় এসে আমাকে পড়াতে আসতেন। তা না হলে পরবর্তী দিনগুলোতে আমিই তাঁর পথ মাড়াতাম না।

আমার নিরুত্তাপ হয়ে থাকা, এবং নিরুত্তরতার সাথে দিন পার করিয়ে নেয়ার মুহূর্তটা তিনি আর সহ্য করতে পারলেন না। একদিন হঠাৎই প্রশ্ন ছুঁড়ে বসলেন। একে প্রশ্ন না বলে অভিযোগ বলাটাই শ্রেয়।
-"কনক, তুমি সেদিনের উত্তর যে দিলে না! যে কোনো একটা উত্তর দিয়ে দিলেই তো হয়! এত ভাব নেয়া কেন?!"

কী সহজে বিনা কম্পিত গলায় তিনি একটা সমাধান দিলেন যেন! যে কোনো একটা উত্তর দিয়ে দিলেই তো হয়! বাহ! যেন বাজারের মুড়িমুড়কির দোকানে পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসে আছেন তিনি। আর আমি ভোক্তা, দাঁড়িয়ে আছি, পণ্য নির্বাচনের দ্বিধা বুকে নিয়ে।

তাঁকে আমার একটা প্রশ্ন সে সময় জিজ্ঞাসা না করলেও আজ জিজ্ঞাসা করতে বেশ ইচ্ছে হয়, "ভালোবাসা বলতে আপনি স্পষ্ট ভাষায় কী বুঝেন?"
.
তবে আমি চুপ করে ছিলাম। জবাব দেইনি। তবে মাথাও নিচু করে রাখিনি। কারণ আমি জানতাম, আমি দোষী নই। আর আমি তাঁকে ভালোও বাসতাম না। আমি শুধু নিজের মুখের উপর একটা প্রশ্ন ফুটিয়ে তুলেছিলাম। সে প্রশ্নে ছিল কিছুটা আপত্তিও। সেই আপত্তির একটা অংশ ছিল এরূপ, "আপনাকে অধিকার ফলানোর অধিকার কে দিল!"
.
চিন্তার পরিপক্বতা বোধহয় সে সময়ে কিংশুক ভাইকে ঘিরে ধরেনি। ক'দিন বাদে আমার পায়ের সাথে মাখামাখি করে তিনি নতুন একটি খেলা খেলতে শুরু করলেন। প্রথমবার এটি পায়ের স্বাভাবিক স্পর্শ লেগে যাওয়ার ভুল মনে করলেও পরে বুঝলাম, এটি একটি মেয়ের স্পর্শ পাওয়ার (বা উপভোগ করার) একটি বহুল প্রচলিত পদ্ধতিমাত্র।

আমি বিরক্ত হতাম, তবুও তিনি মুখে 'দুষ্টুহাসি' ফুটিয়ে তাঁর খেলা খেলে যেতেন। ভেবেছিলেন, হয়ত আমি একদিন তাঁর খেলার বাড়াবাড়িতে হেসে ওঠে আমাদের মাঝের অদৃশ্য দেয়ালটা গুঁড়িয়ে দেব। তবে আমি সহজ হইনি। বরং ওই সময়টায় আমি খুব অসহায়বোধ করতাম। এবং একদিন প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়েই আমি তাঁকে অনুরোধ করলাম, "স্যার, প্লিজ এমনটা করবেন না। খুব খারাপ লাগে।"
এবং আমার এ উত্তর শুনে তিনি সেদিন লজ্জা পেয়ে সেই যে পা সরিয়েছিলেন, আর সেই পা আমার পায়ে ছোঁয়াননি।
.
মেঘের দেখা মিলল হঠাৎ। খণ্ড খণ্ড মেঘ। শরতের মেঘের তুলাকৃতি। অথচ শীত শেষ হয়ে বসন্তের পথে। ছাদে দাঁড়িয়ে এমন মেঘের দেখা পাব, ভাবিনি। মেঘটা চমৎকার দেখাত, যদি সাথে এক টুকরো উজ্জ্বল চাঁদও আকাশে থাকত। সেই মেঘের খণ্ড আড়াল করে নিত উজ্জ্বল চাঁদটিকে। চাঁদের আলো তার ফাঁক বেয়ে পড়ত কোনো এক নারকেল গাছের পাতার ফাঁকে। এবং চাঁদের সামনে সেই মেঘখণ্ডটি আরো স্পষ্ট হয়ে ভেসে ওঠত। এই দৃশ্যপট আমার কল্পনাতেই এখন শুধু ভেসে ওঠছে। চাঁদ নেই বর্তমানের আকাশে। আমার চিন্তাটুকুও বর্তমানে ঠিক এ মুহূর্তে নেই।
.
পায়ের মাখামাখি আর হয়নি। তবে তাঁর চোখদু'টোর চাহনি থেমে থাকেনি। আমি অস্বস্তিবোধে ডুবে যেতাম। তবে তিনি পড়াতেন বেশ ভালো, তাই ভাইয়ার কাছে কোনো অভিযোগও ওঠাতে পারতাম না। প্রাণের বন্ধুর বিপরীতে দাঁড় করানো অভিযোগ আমি নিজেও আমলে নেই না।

মা'কেও বলতে পারছি না। লজ্জা, দ্বিধা এবং ভয়ের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণজাত অনুভূতিতে নিজেকে, নিজের সমস্ত অস্তিত্বকে আবিষ্কার করতাম সেই কঠিন সময়ের প্রতিটি মুহূর্তের শতভাগের সব ভাগেই। রাতের বেলার অশ্রুপাত ছিল নিত্যকার রুটিন। ঘুমটা আসত দেরীতে। পাশে শুয়ে থাকা ছোট বোনটিকে বুঝতেই দিতাম না। অথচ এক পাহাড়সম তিতকুটে স্বাদের বোঝা নিয়ে আমি প্রতিদিন তার সাথে মজার গল্প করে যাই, এবং তাকে ঘুম পাড়িয়ে দেই। নিজেকে যেন ফেলে দিয়েছিলাম এক কঠিন পরীক্ষায়। যে পরীক্ষার কোনো পূর্বপ্রস্তুতি ছিল না বিধায় প্রতি মুহূর্তেই আটকে যেতাম।

Candle, Meditation, Hand, Keep, Heat, Confidence, Rest

.
বড় ভাইয়া প্রায়ই বাইরে ব্যস্ত থাকতেন। তিনি কয়েকটা ট্যুইশনি করাতেন, তবে তাতে নিয়মিত ছিলেন না। ব্যবসায় শিক্ষার ছাত্র হওয়ার কারণেই বোধকরি তখন ব্যবসা করার একটা ইচ্ছেবোধ তাঁর মধ্যে জেগে ওঠেছিল। কাপড়ের ব্যবসা। গার্মেন্টসের রিজেক্টেড কাপড়গুলো কম দামে কিনে নিয়ে একটু বাড়তি দামে সেগুলো বিক্রি করা। এসবের জন্যে অবশ্য গার্মেন্টসে গার্মেন্টসে তাঁকে হয়ত ঘুরতেও হয়েছে। তাছাড়া এতগুলো কাপড়ের মজুদ রাখার মত গুদামঘরের সন্ধানেও হয়ত তিনি ছিলেন। রাতের বেলায় ফিরে খাবার টেবিলে মায়ের সাথে এসব কথাই তিনি বলতেন।

খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আমার ভাইটা। কথা খুব কমই হত আমার সাথে। দেখা হলেই, "কী অবস্থা" প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতেন স্বল্পপরিচিতের মত। এরপর উত্তরের অপেক্ষা না করেই বেরিয়ে যেতেন। তাঁর একটা বন্ধু যে তাঁর ছোট বোনটাকে পড়ায়, এটা যেন তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন; ভাবটা এমন করতেন।
.
তবে সেদিন যা হলো, তা আমি এখনও ভুলতে পারি না। কিংশুক স্যার এসেছিলেন পড়াতে। একটু সময় নিয়েই পড়াচ্ছিলেন সে রাতে। সবকিছু স্বাভাবিক ছিল, শুধু তার দু'টো চোখের চাহনি বাদে।

ঠিক তখনই ঝড়ের বেগে ভাইয়া বাহির থেকে ভেতরে ঢুকলেন, এবং কিংশুক স্যারের মুখে বেশ সশব্দেই চড় বসিয়ে দিলেন। একটা নয়, অসংখ্য! এরপর তাকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে চেয়ার থেকে ঠেলে ফেলে দিলেন। আমি ততক্ষণে নিজের চেয়ার থেকে নেমে পড়েছি। মাটিতে পড়ে থাকা স্যারের শার্টের কলার চেপে ওঠিয়ে দাঁড় করালেন। আরো কয়েকটা চড় মারলেন, পেটে ঘুষি মারলেন। সেদিন আমি জেনেছিলাম, আমার ভাইয়া কত বিশ্রীভাবে গালি দিতে জানেন।

দরজা থেকে বের করে লোহার গেইটের সামনে এনে স্যারকে বেশ করে পিটিয়ে ভাইয়া তাকে বললেন, "শোন ".........", এই গলিতে, এই এলাকায় যেন তোকে আর না দেখি!"
স্যারকে ধাক্কা দিয়ে স্যারের পেছনে বেশ অবমাননার সাথে সজোরে একটি লাথি বসিয়ে দিলেন বড় ভাইয়া।

অথচ পুরো সময়টায় স্যার প্রতিবাদস্বরূপ একটা শব্দ উচ্চারণ বা একটা হাত উচ্চয়ন পর্যন্ত করেননি।
আমাকে সরাসরি জানানো হয়নি; তবে স্যারেরই অন্য আরেক ছাত্রীর সতীত্বহরণের অপরাধেই যে সেদিন তাকে এমন মার খেতে হলো, সেটি আমি জানলাম এর বছরখানেক বাদে।
.
ছাদে কাজল ওঠে এসেছিল। আমার ছোট বোন। পেছনে এসে কখন দাঁড়িয়েছে, লক্ষ্যই করিনি। "আপা, ভাত খাবে না?" চমকে ওঠলাম সামান্য। "খাব তো। তুই খাসনি?" দু'পাশে মাথা নাড়লো কাজল। "মন খারাপ লাগছে আপা, কলেজের এক ছাত্র আত্মহত্যা করেছে তো।" একটু অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকালাম। আসলেই তার মন খারাপ, চেহারায় বিষণ্ণতা ফুটে ওঠেছে।
"ছেলেটা কি তোদের ক্লাসমেট?"
"না আপা, এক ইয়ার সিনিয়র।"
"তাহলে তোর মন খারাপ কেন?"
"ছেলেটা আমার এক বান্ধবীকে পছন্দ করত।"
"ও আচ্ছা।"

আমি বাড়তি কিছু জানতে চাইনি। আমি ঘটনা আঁচ করতে পেরেছি। কাজলের অস্থিরতা দেখে মজা পেলাম একটু। সে উশখুশ করছে। তার ধারণা ছিল, আমি তাকে আরো বিস্তারিত জানতে চেয়ে প্রশ্ন করবো। তবে তার বয়সজাত অস্থিরতা যে আমার মাঝে নেই, এটা তাকে কে বোঝাবে? নিজ থেকে আর কিছু বলতে পারলো না কাজল।
.
আমার এক বান্ধবীর কথা মনে পড়ে গেল। ওর জন্যেও এক ছেলে এরকম বিষ খেয়েছিল। তবে মরেনি। সেই বান্ধবীটির অবশ্য কলেজ পাসের পরে বিয়ে হয়ে গেছে। সে ফ্রান্সে প্রবাসজীবনে আছে। আর ছেলেটাও বিয়ে করেছে। সে একজন সফল খামারী। দু'টো ছেলেও নাকি আছে তার।

আমি ভাবি, খামারী ছেলেটা যখন তার ছেলেদের কোলে নিয়ে চুমু খায়, তখন কি তার মনে পড়ে, এই ছেলেগুলোর মা'কে বিবাহের আগে সে অন্য এক মেয়ের জন্যে বিষ খেয়েছিল? সে কি সেই বিষের অকার্যকারিতাকে প্রতি রাতেই ধন্যবাদ জানায় না? সে কি এখন বুঝতে পেরেছে যে, ওটা ছিল বয়সজাত আবেগীয় ভুল, কিংবা অপরাধ? আমি ছেলেদের সাথে কথা বলি না। তা না হলে এই প্রশ্ন সরাসরিই তাকে গিয়েই করে বসতাম।
.
আজ কাজলের স্কুলে যে আত্মহত্যা করে বসলো, সে কাজলেরই বান্ধবীকে না পেয়ে নিজেকে মেরে জীবনটাকে হারিয়ে নিজেই হেরে গেল। কাজলের বান্ধবী হয়ত এতে কিছুটা মুষড়ে পড়বে, কাঁদবে কয়েক সপ্তাহ, অপরাধবোধে ভুগবে কয়েকটা মাস, এবং বছর গড়াতেই এসব ফিকে হয়ে আসবে। একটা সময়ে সে বিয়ে করবে, তার চমৎকার দু'টো সন্তান হবে, সে তাদের নয়নভরে দেখবে ও আদরভরে ভালোবাসবে। শুধু মাঝেমাঝে, দু'বছরে একবার তার মনে পড়বে, তার জন্যে এক 'প্রেমিকপুরুষ' কোনো একসময় প্রাণ দিয়েছিল। সেই প্রেমিকপুরুষের মৃত্যু খুবই অসার্থক। মেয়েটি তার স্বামীকে পর্যন্ত এই মৃত্যুর কথা জানাবে না। ছেলেটির ঠুনকো 'আত্মত্যাগ' মেয়েটির গড়ে তোলা 'আত্মসম্মান'-এর কাছে ছেলেটির মতই হেরে যাবে।
.
রঙিন পাতার সেই চিরকুটের জবাব আমি সেই ছেলেটির সামনে গিয়েই দিলাম। মাথা নিচু করে ছিল ছেলেটি। আমার মাঝে হয়ত কিছু পরিমাণ ব্যক্তিত্ব ছিল, যেটি তাকে মাথা উঁচু করতে সাহস জোগায়নি।

কিছু কঠিন সত্য অত্যন্ত সহজ গলায় বলেছিলাম। কণ্ঠে তিক্ততা ছিল, রুক্ষতাও ছিল। তবে অবিবেচকের মত সমালোচনা করে যাইনি। সংক্ষেপে কিছু কথা বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। জরুরী ছিল। আমি কোন যুক্তিতে, কোন নির্দেশ মানতে গিয়ে তার প্রস্তাব গ্রহণ করছি না, সেটি বুঝানো জরুরী ছিল। এবং দেখলাম, তার আশেপাশে দাঁড়ানো তার বন্ধুগুলোও মাথা নিচু করে ফেললো।
.
আমি ফিরে আসার আগে ছেলেটি বলেছিল, "আপু, আপনার কথাগুলো আমার বেশ ভালো লেগেছে। আমি তাই....।"
আমি ফিরে এলাম, পুরোটা শুনতে চাইনি। ছেলেটি আমাকে অন্যদের মত করেই বিবেচনা করছে।
.
কাজলকে নিয়ে ছাদ থেকে নেমে এলাম। সেই রাত শেষ হয়ে এলো।
পরদিন সকালে গায়ের বোরকার সাথে মুখে নিকাব এঁটে ভার্সিটিতে বেরিয়ে পড়লাম। শুধু বোরকাটাই এখন যথেষ্ট হচ্ছে না নিজেকে নিরাপদে রাখতে।
বোরকার রঙটি ঠিক গত রাতের আঁধারে ডুবে যাওয়া গাছগুলোর গাঢ়, নিস্তব্ধ অবয়বের গাঢ় রহস্যময়ী কৃষ্ণত্বের সৌন্দর্য্যের মতই।

Post a Comment

Previous Post Next Post