আড়ষ্টতার মাঝে নিজের সমস্ত কৌষিক অস্তিত্বকে অনুভব করছে যাইনাব। টেবিলের উপরে রাখা চায়ের কাপটি হতে ধোঁয়ার উড়ে যাওয়ার প্রহর মিনিটখানেক আগে শেষ হয়ে পড়েছে। চায়ের কাপের মতই স্থির, স্তব্ধ হয়ে যাইনাব একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে নারিকেল গাছটির সরু সবুজ পাতার দিকে, যেটি তার ঘরের জানালার সাথে একরকম লাগোয়াভাবেই ঝুলে আছে। 
দৃষ্টি নারিকেল পাতায়, ভাবনা অন্য আরেক জগতে। যে জগতে প্রতিটি মানুষই প্রতি নিদ্রায় নিজেকে আবিষ্কার করে। সেই জগতে আবর্তিত হতে থাকে তার না-দেখা, না-পাওয়া যাবতীয় বস্তু, আকাঙ্ক্ষাগুলো। সেগুলো কাঠামো পায়, নড়েচড়ে। কখনও চেনামুখ, কখনও বা সম্পূর্ণ কল্পনার কোনো উজ্জ্বলমুখকে সেখানে চলতে দেখা যায়, ফিরতে দেখা যায়। সেই মুখটা হাসে, কাঁদে; হাসায়, কাঁদায়। কখনও সেই মুখ আপন করে নেয় দর্শককে, কখনও দূরে ঠেলে দেয়। কখনও সেই জগতটা স্বর্গ হয়ে ধরা দেয়, কখনও বা ভীষণ বিভীষিকাময়ী হয়ে ওঠে। সেই জগতটার নাম স্বপ্ন। যা মানুষের যাবতীয় চিন্তাভাবনার প্রতিফলনমাত্র।
.
গত রাতে সেই স্বপ্নের জগতে বরাবরের মত ঘুরে এসেছিল যাইনাব। তবে এবারের ঘটনাপ্রবাহ খুব বেশি পরিমাণের অদ্ভুতদর্শন নিয়ে হাজির হয়েছে। এই দর্শনরূপ যাইনাবের পরিচয়ের গণ্ডিকে অতিক্রম করেছে। সে ধাক্কা খেয়েছে বিন্দু পরিমাণ। না, ঠিক বিন্দুর মত অল্পও নয়। এর চেয়ে পরিমাণে আরো বেশি।
.
বাতাসের শীতলতা ছিল সেই জগতে, অনুভব করার মতই যথেষ্ট। মাঠ ছিল, একটি ছোটখাটো খালও ছিল তাতে। ছিল বেশ কয়েকটি পরিচিত ফুলের গাছও। লালে লাজুক কৃষ্ণচূড়া থেকে শুরু করে মুক্তোসম জ্বলন্ত বেলী ফুলের গাছও ছিল। সাথে ছিল বেশ কয়েকটি অপরিচিত গাছও। ফলের গাছ চোখে পড়েনি তাতে, হয়ত থেকেও থাকতে পারে।
স্ফটিক জলের সেই খালের উপর একপাল রাজহাঁস ভেসে ভেসে যেন তাদের রাজ্যজয়ের বিজয়ধ্বনি ছড়িয়ে দিচ্ছিল। বক ছিল, এবং সাথে ছিল গাঙচিল। তাদের ভীড়ে কাকও ছিল। কাক দেখতে কুৎসিত হলেও সেই জগতে তাকেই বেশ চমৎকার দেখাচ্ছিল।
.
এসব গাছগাছালি-পাখপাখালির ভীড়ে আরো একটি স্পন্দিত প্রাণের অস্তিত্ব ছিল সেই জগতে। ফুটন্ত গোলাপের মত স্নিগ্ধ কিংবা সূর্যমুখীর মত তীব্র বর্ণের সজীবতা ঘিরে ছিল সেই স্পন্দিত প্রাণবাহী ছোট্ট শরীরটিকে। সেই শরীরটি ছিল যাইনাবের কোলজুড়ে। হরিণের মত মায়াবী দু'টি চোখের সংকোচ দৃষ্টি সে ফেলেছিল যাইনাবের আবেগাপ্লুত সজল চোখ দু'টিতে। ঘাড় অবধি চুল ছিল সেই প্রাণসখীর। শিশুও নয়, তবে শিশু বালিকা। তবে সেই বালিকা যেন যাইনাবের কোলটাকে জুড়িয়ে দিয়েছে। যেন তার কোলেই সেই বালিকার থাকার কথা ছিল। তাকে মাটিতে নামালে যেন মানাবেই না। তাকে যেন সর্বদা কোলেকাঁখেই থাকা লাগবে।
.
যাইনাব একটি চুমু এঁকে দিল বালিকাটির কপালে। চুমু দেয়ার সময় সৃষ্ট 'চুক' শব্দটি যাইনাবের বেশ প্রিয়। এটি যেন ভালোবাসাময় আদরের একটি শব্দময় প্রকাশ। এটি ছড়িয়ে পড়ে আশপাশকে জানিয়ে দেয় ভালোবাসার মানুষটি তার কত কাছের। সেই ভালোবাসার দ্বিতীয় প্রকাশের জন্যেই বোধহয় যাইনাব আরেকটি চুমু এঁকে দিল। তবে এবার কপালে নয়, গালে। 
.
কেমন কোমল গাল। খুবই নরম। একেবারে তুলোর মত। না, না, তুলো নয়। আরো নরম। বেশ কোমল। তুলনাহীন। খুব আবেগ ঘিরে ধরলো তাকে।
বালিকাটির মায়াবী সংকুচিত দৃষ্টি এবার সহজতায় নেমে এলো। তার কপাল ও গালের আদর মুখে হাসি হয়ে ছড়িয়ে গেল। যাইনাব বেশ স্বস্তি পেল তার এ হাসিটুকু দেখতে পেয়ে। চেপে ধরলো তাকে নিজের বুকে। বালিকাটিও তাকে জড়িয়ে ধরলো। এবং কী আশ্চর্য্যের বিষয়, তার ছোট হাত দু'টোর এমন আন্তরিক আলিঙ্গনে যাইনাবের ভেতরের সমস্ত ব্যথা, দুঃখ, গ্লানি, এবং বিষণ্ণ বোঝা যেন নেমে গেল। সেসব বেরিয়ে এলো তার দু'চোখ বেয়ে। টুপ করে পানি গড়িয়ে পড়লো চোখ হতে। আরেকটু তীব্রতায় বালিকাটিকে সে চেপে ধরলো। হয়ত তার বুকে থাকা অবশিষ্ট বেদনাগুলোও সে নিঃশেষ করে দিতে চায়।
.
খালের ধারে বালিকাটিকে কোলে নিয়েই যাইনাব বসে পড়লো। খালের স্ফটিক জল যাইনাবের স্বভাবের মতই শীতল, তার আবেগের মতই টলটলে। সেই শীতল ও টলটলে জলে পা দু'টো ডুবিয়ে দিল যাইনাব। এক আজলা জল নিয়ে বালিকাটির ছোট পা দু'টোও ভিজিয়ে দিল এক পরম মমতার সাথে। 
পায়ে জল পড়তেই ছোট্ট বালিকাটি খিলখিলিয়ে হেসে ওঠলো। কেমন সুরেলা মিহি কণ্ঠ। কেমন বয়ে যাওয়া স্রোতের মত তরঙ্গময়ী কণ্ঠ। যেন আকাশ হতে গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুরে নেমে পড়া বৃষ্টির নবধারা। সেই নবধারা যেন গড়িয়ে পড়লো  যাইনাবের রুধিত হৃদয়ে। 
রাজহাঁসের পালটি পাক দিয়ে ঘুরে আসছে। ক্ষুদ্র ডিঙি যেন, সফেদ বর্ণের। বালিকাটি চেয়ে আছে সেদিকে, অবাক নয়নে। এবং তার অবাক নয়নে চেয়ে আছে যাইনাব। তার সমস্ত মনোযোগ এই ছোট্ট বালিকাটি। একে পেয়ে সে যেন বহু রাজার ধন পেয়ে গেছে।

.
বক, গাঙচিল উড়ে গেল। সবকটি নয়, কয়েকটি। বকগুলো কীভাবে কীভাবে যেন তাদের সরু ও ঈষৎ লম্বা ঠোঁটকে টোপ বানিয়ে খালের ছোট মাছগুলোকে ছিনিয়ে ওপরে তুলে নিচ্ছে। দেখতে বেশ লাগছে। যেন এক জেলেমাছ। এভাবেই তো তাদের খাদ্যের সন্ধান মেলে।
নিকট দূরত্বে কৃষ্ণচূড়া গাছের উপর কয়েকটি কাক বসে আছে। সংখ্যায় খুব বেশি নয়। তাছাড়া তারা তাদের নীড়েই বসে আছে। তাদের দৃষ্টি যাইনাবদের দিকে। সকলেই যেন তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। যাইনাবের ধারণা হতে লাগলো, মূর্তিমান গাছগুলোও যেন তাদের নিজ নিজ অন্তর্চক্ষু দিয়ে তাদের দেখছে। সকল স্পন্দিত দেহধারী প্রাণীর দৃষ্টির একচ্ছত্র কেন্দ্রবিন্দু শুধু তারা দু'জনই, ভাবতেই যাইনাব শিউরে ওঠছে। চমৎকার আবহের মাঝে কোলে অস্তিত্বশীল এই পুতুলসম বালিকাটি তাকে যেন সর্বসুখ দিয়েই যাচ্ছে।
.
নিজের দিকে বালিকাটিকে ঘুরিয়ে নিল যাইনাব। আবারও তাকালো তার মায়াবী হরিণী উৎফুল্ল চোখ দু'টির দিকে। আনন্দ যেন ঠিকরিয়ে পড়ছে সেই দু'চোখের দু'কোণ বেয়ে। আরেকটু ঘনিষ্ঠে টেনে নিল তাকে সে। একটি চুমু এঁকে দিল তার ঠোঁটে। যেন চিহ্নিত করে রাখা। এই বালিকাটি এখন আর কারো অধিকারে নেই। শুধুই তার। কেউ তাকে ছিনিয়ে নেয়া তো দূরের ব্যাপার, আদরের ছলে গালটুকুও টেনে নিতে পারবে না। সে শুধু তারই। এবং সেও তার। বালিকাটিই আঁকড়ে ধরলো তাকে, নিজের বুকে। এমন আপন করে নেয়ার মত আন্তরিকতা, এমন নিখাদ ভালোবাসা, এই ছোট্ট বয়েসের বালিকাটি কী করে নিজের মাঝে ধারণ করলো; সেটি ভাবতে ভাবতেই একসময় তীব্র আলো এসে যাইনাবকে সেই জগত থেকে ফিরিয়ে নিয়ে এলো। বাইরের আকাশে মুয়াজ্জিনের আযানের সুর তখন ছড়িয়ে পড়ছিল। ঘুমের চেয়ে স্রষ্টার কাছে হাজিরা দেয়াই সর্বোত্তম, এই ঘোষণা ঘোষিত হচ্ছিল সুললিত কণ্ঠ বেয়ে। 
.
ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকালে সময়টা জানা যায়। সকাল সাড়ে আটটা বেজে গিয়েছে। যাইনাবের স্বামী ছুটে গিয়েছেন আড়তে। আড়তদারির পেশায় আছেন তিনি বহুদিন। আড়তদার পেশাদারদের ব্যাপারে আমাদের চিন্তায় যেরূপ চিত্র ফুটে ওঠে, যাইনাবের স্বামী মাযহার সেরূপ নকশার নন কখনোই। গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করা এই মানুষটি খুব ভেবেচিন্তেই আড়তদারির পেশায় নিজেকে ডুবিয়েছেন। এ ধরনের পেশায় ছলচাতুরী, অসততার ছাপ খুব সহজেই রাখা যায়। সেটি থেকে নিজেকে তিনি পৃথক রেখেছেন। তাতে দু'হাতে না হলেও একটি হাতে যতটুকু উপার্জন সম্ভব, ততটুকু উপার্জনেই তো তাদের বেশ চলে যাচ্ছে।
.
যাইনাবের সাথে মাযহারের বিয়ে হয়েছে বছর পাঁচেক। সন্তান নেই। মাযহার অবশ্য সবাইকে বলে, "এখনও সন্তান না নিয়ে সময় নিচ্ছি।" যদিও যাইনাব জানে, এটি মিথ্যে। তবে তাকে সত্য ব্যাপারটিও জানতে দেয়া হয়নি। এদিক থেকে মাযহারকে বেশ বড় মনের মানুষ বলা যেতে পারে।
.
যাইনাব নিজেকে অসহায় ভাবার সুযোগটাই পায় না। মাযহার তাকে এ চিন্তায় ডুবে যাওয়া থেকে প্রতিবারই বাঁচিয়ে তোলে। বিয়ের পাঁচ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও তাদের মুঠোফোনিক আলাপ ঠিক যেন নবদম্পতির মতই। তবে নবদম্পতির আলাপের আদিখ্যেতামূলক বাড়াবাড়ি এবং উপচেপড়া টইটুম্বুরিক আবেগীয় বহিঃপ্রকাশ তাদের আলাপের মাঝে নেই। তাদের আলাপ তাদের ভালোবাসার মতই নিখাদ, সুপরিমিত, সুস্থ এবং মজবুত।
.
গত রাতের সেই স্বপ্ন যাইনাবের কষ্টকে কি বাড়িয়ে তুলেছে, নাকি কমিয়ে এনেছে? এই কুটতর্কে সে যেতে চায়নি। এরূপ তর্কের কোনো অন্ত নেই। এসব চলতেই থাকবে। বরং এই স্বপ্নটাকে ঠিক অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলেই বোধহয় তৃপ্ত হওয়া যাবে।
মাযহার প্রায়ই বলে, "আল্লাহ মানুষের সাথে যেটাই করেন, তার ভালোর জন্যেই করেন।" কথাটি কতটুকু যৌক্তিক, তা যুক্তিবিদ্যার কুটতার্কিকেরাই বিচার করবেন। তবে এই কথা যাইনাব বেশ দৃঢ়ভাবেই বিশ্বাস করে। হতে পারে গত রাতের সেই স্বপ্নটি মহান রব কর্তৃক তার প্রতি আদৃত করা একটি সাংকেতিক বার্তাই বহন করছে। হয়ত মহান রব বলতে চাইছেন, তিনি যাইনাবের সাথেই আছেন। হয়ত সেই মহান রব জানাতে চাইছেন, তিনি তাদের পরীক্ষা করছেন। হয়ত মহান রব সেই স্বপ্নের মাধ্যমেই তাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন বিশেষ কিছু। 
.
ঠিক এর কয়েক মাস বাদেই যাইনাবের প্রেগন্যান্সি টেস্ট জানিয়ে দিল, তার মাঝে কোনো ক্ষুদ্র প্রাণ নিজের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে।
Post a Comment