সূর্যের রোদ পাতার ফাঁক বেয়ে মুখের উপরে ঝিলিক ফেললেও তাতে সাইফুলের চোখমুখ কুঁচকে ওঠেনি। দৃষ্টিসুখের গাম্ভীর্য্যে সে ডুবে আছে। এ এক এমন দৃষ্টি, যার কোনো লক্ষ্য নেই। কারণ চিন্তাটুকু বর্তমানে নেই। আছে অতীতে, আছে দুশ্চিন্তায়। চিন্তিত মানুষ যেভাবে স্থির কোনো বস্তুর উপর অকারণ দৃষ্টি ফেলে, সাইফুলও তা-ই ফেলছে। 
সে দেখলো, তার দৃষ্টির উপর দিয়ে বিরাট এক চিল উড়ে গিয়েছে। খুবই নিকটে ছিল সেটি। চিলকে এতটা কাছ থেকে কখনও সাইফুল দেখেনি। আজ সেটিকে দেখে বাজপাখির মতই লাগলো তার। বাজপাখি সে দেখেছিল টেলিভিশনে, শৈশবে 'না-মানুষী বিশ্বকোষ' বইয়ে। আজ চিলের মাঝে সে যেন সেই বাজপাখির ছায়াই খুঁজে পেল।
নাকে মাছের পুরনো গন্ধ ভেসে ওঠলো। জেলেপাড়া, চারিদিকে মাছের ছড়াছড়ি। জমে ওঠে একেবারে ভোরবেলায়, যে সময় ফযর নামাজের মুসল্লিরা নামায শেষে মুক্ত বায়ুর পরশ পেতে একটু হাঁটতে বেরোয়। মহাসড়কের মতই একটি সড়ক এই গ্রামের পশ্চিমদিকের সমুদ্রের প্রায় কাছ দিয়েই বয়ে গেছে বন্দরের দিকে। ঢাকাগামী বা বন্দরগামী লরি, ট্রাকই শুধু এ সড়ক দিয়ে যাওয়া-আসা করে। তার পাশের খাদের আরেকটু নিচে জনসাধারণের চলাচলের সুবিধার্থে পিচের সড়ক তৈরি করা আছে। ঠিক সেই সড়কের পশ্চিমের বিশাল মাঠ দিয়ে নেমে সরাসরি সমুদ্রে পৌঁছে যাওয়া যায়। জেলেরা রাতভর মাছ ধরে ভোরবেলায় এখানেই সেগুলোর পসরা সাজায়। মুসল্লিদের সাথে প্রাতঃভ্রমণে বের হওয়া নারী-পুরুষেরা সেই পসরার সামনে ভীড় জমায়, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে।
এখন অবশ্য সূর্য গড়িয়ে দুপুরের পথে। সাইফুলও এই ঘণ্টাখানেক আগে এই সমুদ্রতটের মাঠের কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা এই কৃষ্ণচূড়ার গাছের নিচে সটান শুয়ে পড়েছে। সূর্য ঝিলিক ফেলছে, তবুও সে সূর্যের দিকেই তাকিয়ে আছে। এটি উচিত হচ্ছে না। সাইফুলের চোখের দৃষ্টি বিশেষ করে দূরবর্তী দৃষ্টি কিছুটা দুর্বল। সবসময় তাই চোখে মাইনাস টু পয়েন্ট ফাইভের চশমা এঁটে রাখা লাগে। আজ সে চশমা পরেনি। আশৈশব হেঁটে আসা পথটি হাঁটতে তার অবশ্য খুব সমস্যা হয়নি। চশমা ছাড়া তাকে অবশ্য বেশ অসহায় দেখায়। ব্যাপারটি শুধু তার বেলাতেই নয়, সকল চশমাপরিহিতের বেলাতেই প্রযোজ্য। 
চশমা আনেনি। এমন নয় যে চশমার কান ভেঙ্গে গিয়েছে বা কাঁচ খুলে পড়েছে।
 তবে পথ হাঁটতে গিয়ে যদি কোনো পরিচিতজন চশমা নিয়ে কোনো প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, তখন উত্তরটা সে কীভাবে দেবে? সে কী উত্তরে জানাবে যে, চশমা ব্যবহার করতে তার আর ভালো লাগে না? এই উত্তর দেয়ার মত সক্ষমতা তার থাকা তো লাগবে। সে সহজ কথাই তো সহজভাবে বলতে পারে না। সে সত্য বচনে উত্তর দিলে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে উত্তরটা প্রশ্নকর্তাকে বোঝানো লাগবে। সে ঝামেলার প্রয়োজন কী? তার চেয়ে চশমা আনতে ভুলে গেছে বা চশমা ভেঙ্গে গেছে, এরূপ উত্তর দেয়াটাই বেশ সহজ ও স্বল্পসাময়িক।
সাইফুল ওঠে বসলো। পকেট থেকে সে তার স্মার্টফোনটি বের করে নিল। স্মার্টফোন ব্যবহার করাতে তার সমস্যা হবে না। কারণ তার চোখের সমস্যা প্লাসে নয়, মাইনাসে। 
সে এখন কিছু লিখবে। কয়েক মাস হলো, সে লেখালেখিতে বেশ আনন্দ খুঁজে পাচ্ছে। গতানুগতিক রোমান্টিক কাব্য কিংবা গদ্যের দিকে তার লেখার প্রবাহ ঠিক যায় না। তার লেখাগুলো আত্ম-উদ্দীপনামূলক। কখনও শুধু নিছক অনুভূতির প্রকাশমূলক বা কখনও রূপকতার মোড়কে আবৃত।
 সে লিখে নিল,
"ছোট ছোট চিত্রগুলো বয়ে গেছে নদীর সাথেই। নদীর বাঁকে বাঁকে, স্রোতে স্রোতে; সেই চিত্রগুলোকে বয়ে যেতে দেখতাম প্রায়ই। তবে জুতোজোড়াগুলো কোথায় যেন রেখেছিলাম, ভুলেই গেছি।
দিন যায়, মাস যায়, সাথে বছরও যায়। সেই ভেসে চলা চিত্রগুলোর সাথে সাক্ষাতের সুযোগটাও ধীরে ধীরে কমে আসে। ঘাড়ের রগ কোমল থেকে দৃঢ় হয়। ঠোঁটের উপরে গোঁফের রেখা ভেসে ওঠে। সেই নদীর স্রোতে পা ভেজানোর মুহূর্তগুলো স্মৃতিতে রূপ নেয়। 
বহুদিন বাদে সেই চিত্রগুলোকে দেখে আসার সুযোগটা হয়েছিল। পৌঁছে গেলাম সেই নদীতটে। তাকালাম।
তবে জুতোজোড়াগুলো কোথায় যেন রেখেছিলাম, ভুলেই গিয়েছি। তবে বোধহয়, সেগুলোর আর প্রয়োজন হবে না।"


সাইফুল সামনে তাকিয়ে আবারও হারিয়ে গেল চিন্তায়। তার এত কীসের চিন্তা? সে কী জাগতিক কোনো বিষয়ে দুশ্চিন্তিত, নাকি তার লেখালেখি নামক নেশার উৎকর্ষসাধন নিয়ে চিন্তিত? 
সারোয়ার ভাই সাইফুলের লেখার বেশ ভক্ত। সাইফুলের লেখা একটি বাক্যের সাহিত্য সারোয়ার ভাইয়ের চোখে পড়েছিল। খুবই সাদামাটা বাক্য।
 তবুও তাতে বেশ মুগ্ধ হয়েই তিনি সাইফুলকে লিখে দিয়েছিলেন,
"সাইফুল, ভাই আমার। তুমি চমৎকার একটি ছেলে। তোমার মাঝে তোমার সমবয়েসীদের বয়সজাত ছেলেমানুষি খুব কম পরিমাণে আছে। তবে তোমাকে আল্লাহ যে ক্ষমতা দিয়েছেন, তা খুব সৌভাগ্যবানদেরই আল্লাহ দিয়ে থাকেন। সেটা হলো, তোমার লেখার ক্ষমতা। কোনোকিছুকে ভিন্ন আঙ্গিকে, নিজের ক্ষুদ্র বিচারে পরিলক্ষণের ক্ষমতা। 
তুমি সূর্য হতে চেয়েছ। সূর্যকে আল্লাহ দিয়েছেন নিজেনিজে প্রজ্জ্বলনের ক্ষমতা। সূর্যের মাঝে কোনো খুঁত নেই। সে বিদ্রোহী, সে জ্বলন্ত। তবে সব শক্তির উৎস হিসেবে তো আল্লাহ তাকেই বেছে নিয়েছেন। অন্যদিকে, তুমি চাঁদ হতে চাওনি। কারণ, চাঁদের নিজের আলো নেই। সমস্তটাই সূর্যের কাছ থেকে ধার করে নেয়া। তুমি বলতে চাইছো, তুমি চাঁদের মত পরনির্ভরশীল হতে চাও না। নিঃসন্দেহে তোমার এ প্রত্যয় প্রশংসনীয়।
তবে একটা ব্যাপার কী জানো? সূর্যের মত কিন্তু সকলেই হতে চায়। এবং আমাদের সাহিত্যে যে গালভরা অনুপ্রেরণায় বলা হয় যে সূর্যের মত দৃপ্ত হয়ে দীপ্তি ছড়াতে হবে, সেটি পড়তে বা শুনতে চমৎকার। তবে এর পাশাপাশি আমাদের কিন্তু বাস্তববাদীও হওয়া প্রয়োজন।
চাঁদের নিজের আলো নেই। আল্লাহ তাকে আলো তৈরির ক্ষমতা দেয়নি। হ্যাঁ, এটা সত্য যে সে ধার করা আলো দিয়েই জ্বলে যাচ্ছে। তবে এর বদলে সে আর কীইবা করতে পারবে? ধার করা আলো হলেও আকাশের চাঁদ সেই আলো যখন পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে দেয়, সেই মুহূর্তের সৌন্দর্য্যের কথা তো তুমি জানোই। নবদম্পতিরা সেই আলোর নিচে বসে প্রেমময়ী হয়ে ওঠে। মা তার সন্তানকে সেই চাঁদ দেখিয়ে আনন্দ দেয়। কবিরা সেই চাঁদের বন্দনা তাদের কাব্যে গায়। চাঁদকে নিয়ে মানুষের এহেন কর্মকাণ্ডে হয়ত সূর্য ঈর্ষায় নিজের উত্তাপেই জ্বলে যায়। তবে সেও তো কম কিছু পায়নি।
এখানে শেখার বিষয়টি হলো, আল্লাহ সকলের মাঝেই কোনো না কোনো খুঁত রেখেছেনই। তবে এসব এর জন্যে নয় যে আমরা একে অপরকে ছোট করবো। চাঁদের আলো তার নিজের না হলেও সূর্যের সেই আলো তার শীতল সফেদ বুকে প্রতিফলিত হয় বলেই এত চমৎকার দেখায় সেটি। তেমনি তোমার মাঝে যদি কোনো অক্ষমতা থেকেই থাকে, তুমি লক্ষ্য করে দেখবে, আল্লাহ তোমার মাঝে এর বিকল্প কোনো ক্ষমতা দিয়েই দিয়েছেন। অন্যের সাহায্য প্রয়োজনে নেয়া যেতেই পারে। পৃথিবীতে শুধু বোকারাই একা থাকতে চায়। আমি আশা করি, তুমি বোকা নও। সকলের সাথে মিলেমিশেই তুমি এগিয়ে যাবে। তখন দেখবে, তোমার অক্ষমতাকে আর অক্ষমতা বলে তোমার মনে হচ্ছে না।"
সারোয়ার ভাইয়ের এ লেখাটি তিনি সাইফুলের স্মার্টফোনেই লিখে দিয়েছিলেন। সেটির উপর আজ অনেকদিন বাদে সাইফুল চোখ বুলিয়ে নিল। চোখ ছলছলিয়ে ওঠলো তার। সে দাঁড়িয়ে গেল। নবোদ্যম অনুভব করলো নিজের অস্তিত্বের প্রতিটি অংশে। বাতিল করে দিল নিজের মনোমাঝে বিরাজ করা বিষণ্ণতার গ্লানিময় আফসোসটুকুর ইশতেহারপত্রকে।
হতাশা তাকে খুব গভীরভাবে গ্রাস করতে পারেনি। তবুও যতটুকু অবশিষ্ট ছিল, তা ঝেড়ে ফেললো সে।
সে হাঁটছে। হাসছে। ভাবছে। তবে খুবই সতর্কতার সাথে। একটু অসাবধান হলেই হোঁচট খেতে পারে সে। চোখে চশমা নেই। মাথায় পাগলামিও নেই। সাথে দুশ্চিন্তাও নেই। এবং সাবধানের মারও নেই।
অবশ্য একটা চিন্তা তার মাথায় আছে। লেখালেখি এগিয়ে নেয়ার চিন্তাটি। এর জন্যে নিজেকে আরো পরিশ্রমের কষ্টে ডোবাতে হয়।   নিজের ভাষাজ্ঞানকে আরো বিকশিত করতে হবে।
আজ তো ফেব্রুয়ারির ঊনিশতম দিন। দু'দিন বাদেই তো ভাষা দিবস। ভাষা দিবসের প্রচলিত বাঙালিয়ানার আদিখ্যেতায় সে যদিও ডুবে যাবে না। ওসব তার ধাতে নেই। 
যারা সারাটি বছর ভিনদেশের সংস্কৃতির সাথে সংসার করে এই একটা মাসে স্বদেশীয় ভাষার সাথে অস্থায়ী লোকদেখানো প্রেমে ডুবে যায়, তাদের দলে আর যারাই থাকুক, সাইফুল নেই। যদিও রাষ্ট্রভাষা, রাষ্ট্রধর্ম ; এসব বড় বড় ব্যাপার নিয়ে সে তর্কে যেতে চায় না। ভিনদেশি সংস্কৃতি আকাশ বার্তার মাধ্যমে টেলিভিশন হয়ে হয়ে স্বদেশীয় ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধ্বসিয়ে তো দিচ্ছেই বহু বছর ধরে। সাইফুলের এক মামাত ভাই তো সেই ষড়যন্ত্রেরই এক জ্বলন্ত ফসল। হিন্দি ভাষা ছাড়া কথাই বলে না। হিন্দি গান ছাড়া গানই শোনে না।
অন্যদিকে বাংলা ভাষাকে যারা শুদ্ধভাবে চর্চা করে, তাদের নিয়েও হাসিঠাট্টার মানুষের অভাব নেই। সাইফুলের সেই সারোয়ার ভাইয়া শুদ্ধ চলিত রীতিতে কথা বলেন। এটার জন্যে তিনি বহুজনের নিকট হাসির পাত্র। 
"আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো...." মাইকে মাইকেই বেজে যাবে। শুধু লোকদেখানো পুষ্পের অঞ্জলিই ভাসানো হবে। সেই পুষ্পের দাম নেই। বাইশে ফেব্রুয়ারিতে সেগুলো উঠে যাবে ট্রাকের বহরে। ফেলে দেয়া হবে বুড়িগঙ্গার কালো জলে। ভাষার জন্যে প্রাণ দেয়া মানুষদের প্রতি শ্রদ্ধার এই আদিখ্যেতা চলতেই থাকবে নিরন্তর। সে অনুসারে বাংলাকে শ্রদ্ধা করার মত প্রকৃত মানুষেরা আর বাড়বে না। বাংলা শেখার জন্যে কেউ এগিয়ে আসবে না। স্পোকেন ইংলিশের দীক্ষা নেয়ার সারিটাই লম্বা হবে শুধু।
 মায়ের ভাষা হোক, বা যার ভাষাই হোক; এটি একটি ভাষা। অথচ এই ভাষার ভাষীরাই একে এখনও প্রাণ থেকে ভালোবাসতে পারেনি। এর ভালোবাসা ভেসেই গিয়েছে সেই কালো জলে ভেসে যাওয়া ফুলগুলোর মতই। 
সাইফুল হয়ত বাংলা ভাষার গল্পকার হয়ে ওঠবে কখনও। বাংলা ভাষাকে তো তার ভালোবাসতেই হবে। তাই তার মাঝেমাঝে চিৎকার দিয়ে বলতে ইচ্ছে করে, "বাংলাকে ভালোবাসতে চাই!" 
একটাই আফসোস সাইফুলের। সে এই কথা এই জগতে উচ্চারণ করতে পারবে না। ইশারাই হলো তার একমাত্র ভাষা।
Post a Comment