চারচাকার টেম্পোর মাঝামাঝি অংশে খালিক বসে আছে। তার দু'পাশে তাকেসহ তিনজন করে মোট সাতজন বসেছে, তাও এক সারিতে। অপর সারিতে পুরুষ-মহিলাসহ সাতজন বসেছেন। এবং টেম্পোর নামার মুখে দাঁড়িয়ে আছে পাঁচজনের মত মানুষ। টেম্পোর অবস্থা দেখে যে কারো মাথাতেই দেশের জনসংখ্যার সমস্যা মাথায় এসে ভিড় করবে। যদিও যত বেশি প্যাসেঞ্জার, টেম্পোচালকের তত বেশি লাভ। 
বিপরীত পাশে বসা তিন কিশোরীর দিকে সকলের পুরুষালি নজর অত্যন্ত তীর্যকভাবেই পড়ছে। তারা অবশ্য আর দশটা বাঙালি মেয়ের মত লজ্জানত হয়ে বিব্রত হচ্ছে না। তারা তো এ যুগের, এই একবিংশ শতকের মেয়ে। তাদের কান বেয়ে ঝুলছে হেডফোন, তা মিলিত হয়েছে তাদের হাতের স্মার্টফোনের মাথায়। তারা গানও শুনছে, আড্ডাও দিচ্ছে।
তাদের বিপরীতে পুরুষদের মাঝেই সম্ভবত তাদের পরিচিত কোনো ছেলে বসেছে। কথাবার্তার ধরন শুনেই বুঝা গেল তারা কলেজপড়ুয়া।
-"জিকু, তোমাকে ওই মেয়েটা আর ফোনটোন করেনি?"
-"ওকে আমি পাত্তা দিই নাই। আরেকজনের সাথে আমার লিংক হয়েছে, বুঝলে?"
সেই কিশোর বয়েস হতেই খালিক শুনে আসছে, অন্য কিশোর-কিশোরীদের এমন খোলামেলা আলাপন। বরং এর তীব্রতা ফি বছরের গ্রীষ্মের উত্তাপের মতই যেন ক্রমবর্ধমান হারে বেড়েছে। কান পাততে হয় না, শুধু কানের উপরে কোনো আবরণের স্পর্শ না থাকলেই চলবে; এসব শোনা যায় সেই দূর অবস্থান থেকে। এমন ঠুনকো বিষয়ে তাদের এমন পরিশ্রম ও অবদান দেখে মনে হয় যেন এসবই তাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য, একমাত্র উদ্দেশ্য। 
কিশোর-কিশোরীগুলো একে অপরকে বন্ধু হিসেবে প্রমাণের চেষ্টায় থাকলেও ছেলেটির হাবভাবে সেটি প্রমাণিত নয়। সে চেষ্টা করে যাচ্ছে নানান আলাপের বিষয় এনে, সেগুলোর সাথে নিজের দক্ষতা ও যোগসূত্রতা তুলে ধরে সফেদ বরনের সেই কিশোরীদের মুগ্ধ করে তুলতে। এবং তারা মুগ্ধ হচ্ছেও। তবে কিশোরটি যেভাবে চাচ্ছে, হয়ত সেভাবে নয়। তাদের মুগ্ধতা সাময়িক, যেটা তাদের কানের হেডফোনে গাইতে থাকা পুরুষ গায়কের কণ্ঠের প্রতি উথলে উঠা মুগ্ধতাকে ছাপিয়ে যেতে সক্ষম হচ্ছে না। 
এমন পরিবেশে খালিক বরাবরের মতই বিব্রত হয়ে থাকে, মাথাটা ঘুরিয়ে বাইরের দৃশ্যে নজর বুলায়। অবশ্য এখন রাতের প্রথম প্রহর। এ সময়টায় বাইরে দেখার মত কিছু থেকে থাকলেও তা দেখা যাবে না। তাছাড়া শহরে দিনের আলোতেও তো দেখার মত কিছু নেই।
খালিক যাচ্ছে তার কয়েকজন বন্ধুর সাথে দেখা করতে। অনেকগুলো মাস তারা একে অপরকে দেখেনি। একে অপরের সাথে বন্ধুসুলভ হালকা রসিকতায় আদৃত করেনি। তাদের কাঁধে হাত রেখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁটাও হয় না বহুদিন ধরে।
এখন অবশ্য দায়িত্ব এসেছে কাঁধে, সাথে এসেছে কিছু পিছুটান। ঘণ্টার পর ঘণ্টা না কাটালেও একটা ঘণ্টা অন্তত যেন কাটানো যায়, সেই উদ্দেশ্য মনের মাঝে চেপে এই শীতের রাতে গায়ে সোয়েটার ও চোখে প্লাস টু পাওয়ারের চশমা এঁটে সে বেরিয়ে পড়েছে। 
গাড়িতে থাকলে কত অজস্র চিন্তাভাবনাই না মাথায় এসে ভীড় করে। গাড়ির চাকার মতই চঞ্চল সেসব চিন্তাগুলো। অমসৃণ পথের মতই উঁচুনিচু সেসব ভাবনাগুলো। অতীতের বিচ্ছিন্ন ঘটনা এবং তার সাথে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তার মিশেলে এমন এক জগাখিচুড়িময় ভাবনার মাঝে ডুবে যাওয়ার এই অভ্যেস খালিকের পুরনোই। সে বিরক্ত হয় না। বরং উপভোগই করে যায়। চোখে কতকিছুই পড়ে, সেগুলো মাথায় যায় না। মাথাটা ব্যস্ত নিজের কাজে। চোখটা তো শুধু সামনে চেয়ে আছে।
"মামা, আমাকে নামায়ে দিয়েন।"
খালিকের ডানপাশের লোকটি একটু উঠে গেলেন। তিনি নামবেন। খালিকের গন্তব্য এখনও নিকটে আসেনি। টেম্পোর নামার পথের সংকীর্ণতার কারণে লোকটির নামতে কষ্ট হচ্ছিল। খালিক তার হাঁটু দু'টোকে আরেকটু পেছনে টেনে আনলো। লোকটি নেমে গেল। এবং সাথেসাথে নেমে গেল টেম্পোর মুখে দাঁড়ানো পাঁচজন যাত্রীও।
ভাড়া পরিশোধের কাজ সমাধা হতে টেম্পোটি থেমেছিল। এরই মধ্যে এক ভদ্রলোক একটি বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে টেম্পোতে উঠতে চাইলেন। তবে তিনি দেখলেন, টেম্পোতে একজনের বেশি মানুষের বসার জায়গা হবে না। তিনি বেশ স্বাস্থ্যবান, সে তুলনায় তার সাথে থাকা ছেলেটির গড়ন তার বয়েসী বাচ্চাদের মতই। হয়ত ছেলেটি সেই ভদ্রলোকের পুত্র, কিংবা ভাতিজা, কিংবা ভাগ্নে গোছের কেউ হতে পারে। ভদ্রলোক তাঁর সেই পুত্র, কিংবা ভাতিজা, কিংবা ভাগ্নে গোছের ছেলেটির আরামের কথা ভেবেই হয়ত তাকে ভেতরে ঠেলে নিজে দাঁড়িয়ে গেলেন টেম্পোর মুখে। ছেলেটি ভেতরে ঢুকতে লাগলো। কোথায় বসবে, সেটা নিয়ে সে সাময়িক দ্বিধায় পড়ে যাওয়ার আগেই খালিক তার হাতটা চেপে ধরে তাকে তার ডানপাশে বসিয়ে দিল। 
ছেলেটি চুপচাপ বসে গেল। এদিকওদিক তাকাচ্ছিল, কিন্তু শান্ত ভঙ্গিতে। হাত দু'টো মুঠ করে সে এমনভাবে বসে রইলো, যেন সে কোনোকিছুর অপেক্ষায় আছে।
খালিক ছেলেটির দিকে তাকালো। এবং সে ফিরে গেল এক ভাবনায়।
ছেলেটির মাঝে সে যেন নিজের শৈশবের ছায়া খুঁজে পেয়েছে। ছেলেটির মাথার চুল ডানপাশে সিঁথিকাটা। চুলের চকচক ভাবটাই বলে দিচ্ছে তাতে তেল মাখিয়ে দেয়া হয়েছে। হতে পারে, তার মা পরম যত্নে তার মাথায় তেল দিয়ে চুল আঁচড়ে দিয়ে সিঁথি কেটে দিয়েছেন ডানদিকে। যেমনটি ঠিক খালিকের মা করতেন তার শৈশবকালীন সাজসজ্জার বেলায়।
শৈশবে খালিক একাকী কোথাও বসলে এভাবেই হাত দু'টো মুঠ করে রাখত, এবং শান্ত চোখে ও শান্ত ভঙ্গিতে এদিকওদিক তাকাত। এবং তার দু'চোখে ছিল একটা করুণ, মায়াবী আবেশ; ঠিক এই ছেলেটার চোখের মতই।
অন্তর্স্বভাবের সেই শৈশবের খালিকই যেন এখন এই টেম্পোর ঠিক মাঝামাঝি অংশে বসা যুবক খালিকের পাশে বসে রয়েছে।
খালিক তো অনেকটা বছরই পেরিয়ে এলো সেই স্নিগ্ধ শৈশব থেকে। বয়স তার একুশ চলছে। এখন সে চুলে তেল দেয়, মাঝেমধ্যে। চুল আঁচড়ায়, তবে ডান-বাম সিঁথি কেটে নয়; বরং পেছনের দিকে, যাকে সবাই 'ব্যাকব্রাশ' বলে থাকে। আর তার চোখে এসেছে প্লাস টু পাওয়ারের চশমা। এখনও সে কিছুটা অন্তর্স্বভাবী, তবে শৈশবের মত নয়। তার মুখে এখন দাড়ি, অল্পস্বল্প হলেও তা চোখে পড়ার মতই। সে পুরুষ হয়ে উঠছে গায়ে-গতরে।
নিজের ডান হাতটা সেই ছেলেটার ডান কাঁধে রাখলো খালিক। ছেলেটি এতে তার দিকে নজর ফেরালো। চশমার ফাঁক দিয়ে স্নেহের দৃষ্টি ফেলে মুখে হাসি ভরিয়ে খালিক তার নজরের জবাব দিল। ছেলেটিও হাসলো, যেমনটি প্রতিটি শিশুই হাসির জবাবে হাসে।
একটা শূন্যতা খালিককে ঘিরে ধরলো। খালিকের বড় ভাই আছেন, চাকুরীজীবী। তবে বয়সের দিক দিয়ে তার কাছাকাছিই বলা চলে। ছোট একটা বোনও আছে, সে তার চেয়ে পাঁচটা বছরের ছোট। শূন্যতা তাহলে কীসের? খালিক তো তাহলে সবাইকে অন্তত এটা বলতে পারে, "আমার ভাইও আছে, বোনও আছে।" 


তবে সে এটা বলতে পারবে না, আমার ছোট ভাই আছে। এবং ঠিক সেটির অভাব, সেটির শূন্যতাই ঠিক রাতের প্রথম প্রহরে, এই যাত্রীবোঝাই টেম্পোর গর্ভেই তাকে ঘিরে ধরলো। পাশে বসা সেই ছেলেটার মত যদি তারও একটা ছোট ভাই থাকত- এ জাতীয় চিন্তা তার মাথায় ঘুরতে লাগল।
মানুষের যাবতীয় বস্তুগত অভাববোধই তাকে সেই বস্তুর বিষয়ে একটি ফ্যান্টাসি বা কল্পনায় ডুবিয়ে নেয়। যার অর্থের অভাব, সে অর্থ থাকলে কী করতে পারত, এই ফ্যান্টাসিতে ডুবে যায়। বস্তুর সাথে সাথে জ্বলজ্যান্ত যেকোনো কিছুর অভাববোধেও মানুষ ফ্যান্টাসিতে ডুবে যায়। খালিকের কোনো ছোট ভাই নেই। সে তাই সে সংক্রান্ত ফ্যান্টাসিতে ডুবে গিয়েছে।
ছোট ভাই থাকলে কেমন হত তার? ভাবতেই আনন্দ হচ্ছে। ছোট একটা ভাই, তার খেলার সাথী হত কিংবা সমর্থক হত। তাকে নিয়ে সে অনেক কিছুই পরিকল্পনা করতে পারত। হাতে হাত ধরে তাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারত। 
ছোট ভাইকে সে কী দিত? আদর দিত, ভালোবাসা দিত। তার ছোট ছোট আবদার পূরণ করত। তার কোনো বিপদে ছুটে আসত। তাকে তার ক্লাসের কোনো দুষ্টু ছেলে বিরক্ত করলে সেটির প্রতিরোধক হিসেবে নিজেকে দাঁড় করিয়ে দিত। খালিকের মাথায় কিছু পরিকল্পনা আছে, সেগুলো তাকে দিয়ে বাস্তবায়ন করাত। কী মজাই না হত! সকলকে সে বলতে পারত, "হুঁহ, আমারও ছোট ভাই আছে! সবাই চেয়ে দেখো!"
তবে এখানেও 'কিন্তু' আছে, ঠিক উজ্জ্বল চাঁদের উঁচুনিচু 'কিন্তু'র মতই। ছোট ভাই থাকলে সে কী করবে, এরূপ চিন্তার পথ ধরে তার মাথায় যতগুলো ব্যাপার এসেছে, তার অধিকাংশই তো কর্তৃত্ব বাস্তবায়নের মেমোরান্ডা হিসেবে এসেছে। অনেকটা নির্বাচনী ইশতেহারের মতই।
ছোট ভাই মানেই কি তাহলে বড় ভাইদের কর্তৃত্ব ফলানোর একটা উৎকৃষ্ট মাধ্যম!? জবাবে 'না' বলার আগে সেটা আরেকবার ভেবে দেখা দরকার। হতেও তো পারে।
খালিক কি তবে একচ্ছত্র কর্তৃত্ব ফলানোর অতৃপ্ত বাসনা থেকেই ছোট ভাইয়ের অভাববোধের নীল সরোবরে পানি পান করতে নেমেছে? এর পেছনে কি তার কোনো জোরালো যুক্তি আছে?
খালিকের ছোট ভাই না থাকলেও সে নিজে একজনের ছোট ভাই। সে একটু ভেবে দেখে, তার বড় ভাই কি তার উপর কখনো কর্তৃত্ব ফলানোর মত কিছু চাপিয়ে দিয়েছে কি না। এবং সে অনেকগুলো ঘটনা আবিষ্কার করে ফেললো।
মানুষের স্বভাব হচ্ছে, সে নিজেকে বড় অত্যাচারিত বা মজলুম মনে করে। সে ভাবতে থাকে, আশেপাশের যত পরিচিত মানুষ আছে, সকলেই তার উপর শুধু মানসিক অত্যাচার ও আধিকারিক অবিচারই করে গিয়েছে। অত্যাচার ও অবিচারের যাঁতাকলে পড়ে সে নিজেকে বিধ্বস্ত, বিষণ্ণ, এবং কিছুটা হতাশ বলে মনে করতে থাকে। খালিকও তাদের দলের বাইরের কেউ নয়।
এবং মানুষের এমন স্বভাবের কারণেই তার প্রতি করা অজস্র মানুষের অজস্র অনুগ্রহকে সে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় ভুলে গিয়ে এক মোটা চামড়ার অকৃতজ্ঞে পরিণত হয়। এবং সেটাও হয় সম্পূর্ণ নিজের অজান্তেই।
খালিক শুধু তার প্রতি করা তার বড় ভাইয়ের নেতিবাচক ঘটনাগুলোই মনে করতে পেরেছে। অথচ ছয়টা নেতিবাচক ঘটনার বিপরীতে যে অগণিত ইতিবাচক ঘটনাও আছে, সেটি তার স্বার্থপর মস্তিষ্কে কোনোভাবেই যেন আসছে না। এর পেছনের কারণ, তার ও তার বড় ভাইয়ের মাঝে সৃষ্টি হওয়া একটি সাম্প্রতিক দূরত্ব। খালিক একে মনে করে 'কোনো কারণ ছাড়াই তৈরি দূরত্ব।' অথচ এ জগতে কারণ ছাড়া কোনোকিছুই যে ঘটে না, এই কথা খালিকের মুখে মুখে ফেরে।
তবে খালিকের স্বার্থপরতা ছাপিয়ে তার বিবেকবোধ জেগে ওঠে। সে স্মরণ করতে থাকে তার প্রতি ঢেলে দেয়া তার বড় ভাইয়ের অজস্র স্নেহপূর্ণ আচরণ ও প্রতিদান। বড় ভাইয়া অধিকার ফলাননি, বরং দায়িত্ব পালন করে গেছেন তার পক্ষে যতদূর সম্ভব হয়। মানুষ হিসেবে তিনি কিছুটা একরোখা, একগুঁয়ে হলেও সেসবকে পাত্তা দেয়াটা যৌক্তিক হবে না। কারণ, সময়ের কশাঘাত তাঁর উপরেই সবচেয়ে বেশি পড়েছে। সেই আঘাতের চিহ্নের দিকে তাকালে তাঁর সমস্ত চারিত্রিক সীমাবদ্ধতাকে নিমেষেই ক্ষমা করে দেয়া যায়। খালিক নিজেকে প্রবোধ দিল, এবং বড় ভাইয়ের প্রতি তার মনে এসে যাওয়া সেই আপত্তিকর ধারণার কারণে নিজের কাছেই লজ্জিত হলো।
পাশের ছেলেটির দিকে সে আবার তাকালো। ছোট ভাইয়ের তৃষ্ণাটুকু আবার জেগে ওঠলো যেন।
খালিক সময়ে সময়ে অনেক কিছুরই অভাববোধ করে। এখন অনুভব করছে ছোট ভাইয়ের অভাববোধ। গত পরশুদিন অনুভব করেছিল বড় বোনের অভাববোধ। এবং প্রায় প্রতিটা দিন ও বিশেষ করে রাতের বেলাতে সে অনুভব করে এক সঙ্গিনীর অভাববোধ।
তবে সঙ্গিনীর অভাববোধের সাথে বাকি দু'টোর অভাববোধের ঠিক মিল খায় না।
ভাই-বোনের সম্পর্কের মত নির্মল সম্পর্কের অভাববোধের সাথে সঙ্গিনীর অভাববোধ-যার প্রায় পুরোটাই যৌনতাকেন্দ্রিকতায় ভরপুর- এমন অভাববোধের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়াটা কষ্টের হওয়ার কথাই। তবে সঙ্গিনীর সম্পর্ক, এবং ভাই-বোনের সম্পর্ক, এসব স্বতন্ত্র ব্যাপার। কোনোটাই কোনোটার চেয়ে কম নয়। ভাতের বদলে শুধু পানি খেলেই শরীরের চলে না। আবার পানি না থাকলে ভাত হজমও হবে না সহজে।
মাঝেমধ্যে হলেও বড় বোনের অভাববোধ সে প্রায়ই অনুভব করে। একটা সময়ে একটা প্রাইভেট স্কুলে ছিল সে। সাধারণ কম্পিউটার অপারেটর পদে। সে স্কুলে শিক্ষিকাদের সংখ্যাই ছিল বেশি, যেহেতু শিশুদের স্কুল। সকলেই ছিল খালিকের চেয়ে সাত থেকে দশ বছরের জ্যেষ্ঠ। খালিকের চরিত্রগুণে এবং কাজে নিবিড় মনোযোগ ও সহযোগী মনোভাবের কারণে তাদের প্রায় সকলেই তাকে স্নেহ করতেন। তাদের সকলকে না হলেও তিন-চারজনকে খালিক পেতে দিয়েছিল বড় বোনের আসন। তার বড় বোনের সেই শূন্য আসনটি ভরিয়ে তুলেছিল এই তিন-চারজন শিক্ষিকা। তাই যখনই সে সুযোগ পেত, দায়িত্বের বাইরেও তাদের অজস্র কাজ করিয়ে দিত। ফলাফলস্বরূপ, সেই চাকরি ছেড়ে দেয়ার পরেও তাঁরা এখনও নিয়মিতই যোগাযোগ রাখে তার সাথে।
বড় বোনের অভাববোধ অবশ্য তাকে অতটা কুঁকড়ে খায় না, যেমনটা খায় ছোট ভাইয়ের অভাববোধটুকু।
তার কাছে মনে হয়, ছোট ভাই থাকলে তাকে অনেক কিছুই বলার ছিল তার। নিজের অনেক গহীনের যন্ত্রণা তার কাছে তুলে ধরতে পারলে হয়ত সে স্বস্তি পেত।
তবে সে কী স্বস্তি পায় না? তার ছোট বোন তো আছেই। তার সাথে কি সে প্রায় সবকিছুই ভাগ করে না? অবশ্যই করে। এবং খালিকের তো এটাতেই যথেষ্ট স্বস্তি পাওয়ার কথা।
খালিকের বেশ কয়েকজন বন্ধু তাকে প্রায়ই বলে, "খালিক রে, তোর কপালটা যে কত ভালো। তোর একটা ছোট বোন আছে। আর এদিকে দ্যাখ, আমাদের ছোট বোন নেই। তুই তো খুব আনন্দেই আছিস। ছোট বোনকে নিয়ে হাসিঠাট্টা, দুষ্টুমি করতে পারিস। আমরা তো সেটাও পারি না।"
খালিকের ছোট বোনের ব্যাপারটায় সে অতটা গুরুত্ব দেয়নি সে সময়ে। তবে গত মাসেই সে একটা বড় ধাক্কা খেল, যখন তার ছোট বোনটা বার্ষিক পরীক্ষাপরবর্তী ছুটি কাটাতে মামার বাড়িতে চলে গেল সপ্তাখানেকের জন্যে। কী এক অদ্ভুত শূন্যতা যেন ছেয়ে গেল খালিকের মাঝে, ঠিক তার বোনের রুমের শূন্যতার মতই। 'কিছু একটা নেই' -এমন হাহাকার ছড়িয়ে ছিল চারদিক। বাহির থেকে বাসায় ফিরে কী কী ঘটেছে, তা ভাগ করার মত ঘরে কেউ নেই। সপ্তাখানেক বাদে তার বোনের ঘরে ফেরার সেই মুহূর্তেই খালিক বুঝতে পারল, সে কতটাই না ভালোবাসে তার এই ছোট বোনটাকে। সেদিন একগাদা চকলেটও কিনে এনেছিল সে তার ছোট বোনের জন্যে। 
সঙ্গিনীর অভাববোধটাও চরম মাত্রার। সাবেক কর্মস্থলে সে শুধু বড় বোনের আসনই পেতে দেয়নি, আরো পেতে দিয়েছিল সঙ্গিনীর শূন্য আসনটিও। দুর্বল হয়েছিল দু'জনের প্রতি। আকর্ষিত হয়েছিল কিছুটা জোরালোভাবেই। তারা ছিল খালিকের চেয়ে বছর দুয়েক জ্যেষ্ঠ। 
তবে মুখ ফুটে কিছু বলে ওঠার আগেই সে আবিষ্কার করলো, এটা বাস্তবসম্মত অভাববোধ নয়। তারা এতে সম্মত হবেন না, হওয়া উচিতও নয়। শুধু ঠোঁটে চুমু খাওয়া, ও রাত্রিবেলায় শয্যাসঙ্গী হওয়া মানেই সঙ্গিনী নয়। বরং এটি আরো বড় কোনো অর্থবহন করে। সেই অর্থ বুঝতে খালিককে আরো বেশ কয়েকটা বছর সময় নেয়া লাগবে।
এতকিছুর পরেও যেটি নেই, সেটি নিয়ে কল্পনারসে ভেসে বেড়ানো কল্পবিলাসী মানুষের মুদ্রাদোষ।
ছোট ভাই না থাকুক, বড় বোন না থাকুক, মেয়েবন্ধু না থাকুক। এসব হতে যে স্রষ্টা তাকে বঞ্চিত রেখেছেন, এর পেছনে নিশ্চয়ই তাঁর কোনো বড় যুক্তি আছেই। মানুষের চেয়ে মানুষের স্রষ্টাই তো জানেন কোন বিষয়টি তার জন্যে অতীব কল্যাণকর। সেটা স্রষ্টাই জানেন, আমরা জানি না। তাই কী নেই, তার পেছনে ছুটে, তাকে নিয়ে দিবারাত্রি কল্পনায় ডুবে অযথা নিজের চিন্তাশক্তি, সৃজনশীলতা ও সর্বোপরি নিজেদের এই মূল্যবান সময়টুকু নষ্ট করে ফেলার কোনো মানেই হয় না। আমরা তো মানুষ। পুরো মানবজাতি আমাদের কাছ থেকে হাহাকার নয়, বরং উৎকৃষ্ট কিছুই আশা করে। সেই আশায় গুঁড়ে বালি হতে দেয়া উচিত নয় এই অদ্ভুত কল্পবিলাসের তরী বেয়ে বেয়ে।
"জামাল খান মোড় আছে?"
হেল্পারের হাঁকে সম্বিত ফিরে পেল খালিক। তার গন্তব্য এসে পড়েছে। তাকে নেমে পড়া লাগবে। পাশের ছেলেটির কাঁধ থেকে হাত উঠিয়ে নিল সে। চিন্তার সাগর থেকে উঠে পড়ে সে যেন গাঝাড়া দিয়ে উঠছে। আহা, মানুষের চিন্তার গতি বেশ অদ্ভুতই। ছোট ভাই, বড় বোন, সঙ্গিনী; কতকিছুই না আসলো ভাবনায়। 
খালিকের সাথে সাথে সেই কিশোরকিশোরীরাও নেমে পড়েছে। তারা ফুটপাথে দাঁড়ানো স্ট্রিট ল্যাম্পের নিচে একত্রে দাঁড়িয়ে অদ্ভুত মুখভঙ্গি করে সেলফি স্টিক লম্বা করে দিয়ে সেলফি তুলে যাচ্ছে। খালিক পাশ কেটে চলে এলো। এইমাত্র এক মেয়েবন্ধুর অভাববোধ তাকে প্রায় গ্রাস করে নিচ্ছিল। তবে তার যা নেই, সেটা নিয়ে আফসোস করা তার সাজে না। বরং তার যা আছে, সেটির দিকেই এগিয়ে যাওয়া তার সাজে।
এই ঘটনার মিনিট বিশেক পরে দেখা গেল খালিকের সমবয়েসী এক যুবক খালিককে জাপটে ধরে আছে। তার চোখে পানি। খালিক আজ তার সেই বন্ধুর অভাববোধটুকু পূরণ করতেই এই শীতের রাতে গায়ে সোয়েটার চেপে চোখে প্লাস টু পাওয়ারের চশমা এঁটে বেরিয়ে পড়েছিল। তখন চারপাশে কুয়াশা ছিল না। আর এখন, কুয়াশা যেন চারপাশ অস্পষ্ট করে নিয়েছে। ঠিক মানুষের যাবতীয় অভাববোধের অস্পষ্টতার মতই।

Post a Comment