টিপটিপ করে বৃষ্টি ঝরতে ঝরতে ছোটখাটো এক সরোবরই গড়ে ওঠলো। মানুষের সরোবর নয়, নয় পশুপাখিরও। পিঁপড়ের সরোবর। তারা তা থেকে পানি পান করে কি না, কিংবা তাতে তাদের নিত্যনৈমিত্তিক প্রয়োজন পূরণ করে কি না, তা জানা নেই।
সেই সকালবেলা থেকেই নিরন্তর বৃষ্টি ঝরে ঝরে চারপাশের পরিবেশটার মত আমাকেও ঝিমিয়ে তুলেছে। ঝিমোনো ভাবটা চা-পানেও ঠিক কেটে ওঠছে না। কর্মস্থলে তাই অন্যান্য দিনের মত একনাগাড়ে কাজ করে যেতে পারিনি।
আজকের লেখাটাকে আমি কী ধরনের লেখা বলবো? রোজনামচা, নাকি উদ্দেশ্যপূর্ণ কোনো লেখা? একে এর মতই ভেসে যেতে দিই। দেখি তরী কোথা যেয়ে থামে, বা ডুবে।
সাহিত্যচর্চাটা আগের চেয়ে কিছুটা ঝিমিয়ে এসেছে। এর প্রধান কারণ নিগূঢ় ব্যস্ততা। এবং তার সাথে রয়েছে সবুজ মনের অভাবের হাহাকারটুকুও। সাহিত্যচর্চার এই অভ্যাসের ব্যাপারে জ্ঞাত আছেন বেশ ক'জন প্রিয় সহকর্মীও। তাঁদের জন্যেও তাঁদের নিয়ে কদাচিৎ হাত ও কি-বোর্ডের সমন্বয়ে বেরিয়ে আসত বেশ কয়েকটি স্নেহ-ভালোবাসাময় সাহিত্য, বেয়ে বেয়ে পড়ত বেশ কিছু তাল, ছন্দহীন কাব্যও। তাতে আদৃত করতাম তাঁদের। এবং সেগুলোর দ্বারা তাঁদের নিকট আদৃতও হতাম। 
আজ অফিসে এক সহকর্মী আমায় ডাকলেন দূর থেকে। ভেবেছিলাম, কোনো প্রয়োজনে ডেকেছেন। প্রয়োজনই ছিল সেটা। 'কেমন আছেন?' জানতে চাওয়াটাও অতীব প্রয়োজনের তালিকায় পড়ে। 
ব্যস্তসমস্ত মুহূর্তের মাঝে এই প্রশ্ন দ্বারা জিজ্ঞাসিত হওয়ার পর কেন যেন মনে হলো ঠিক মাথার উপর থেকেই স্নিগ্ধতামাখানো বারিধারা বর্ষিত হতে হতে আমাকে পুরো ভিজিয়ে শান্ত, নির্মল করে তুলেছে। ব্যস্তসমস্ত একঘেয়ে সেই অনুভূতি পুরোপুরি উড়ে না গেলেও কিছুটা যেন মুছে গিয়েছিল। ফলাফল, মুখখানা প্রসারিত হলো এক অমায়িক হাসিতে। আমার হাসি সহকর্মীর মুখেও ছড়িয়ে পড়লো। কিছু কুশলাদি বিনিময়ের পর তিনি আর আমি, ফিরে গেলাম যার যার দায়িত্ব পালনে।
সহকর্মীদের এমন ছোটখাটো ভালোবাসাময় আচরণেই অভিজ্ঞতার নবীন ঝুলিটা ধীরে ধীরে পূর্ণ হতে থাকে। পূর্ণতায় ভারী হতে থাকে সেটি। এখনও যা চলমান। 
চিন্তার ধার হচ্ছে তীক্ষ্ণ, কথাবার্তায় ফিরে আসছে গোছানো ভাব, চেনা হচ্ছে অজস্র মানুষকে।
এর সাথে দেখেছি বিচিত্র মুখের বিচিত্র সব মানুষ। আচার-আচরণে কাউকে পরোয়া না করা মানুষেরও দেখা পেয়েছি। অল্পদিনেই একেবারে আপন করে নেয়া হৃদয়ও পেয়েছি।
যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করি, তা থেকে দায়িত্ব সম্পর্কিত অভিজ্ঞতার পাশাপাশি পাচ্ছি আরো নানারূপ অভিজ্ঞতা। দু'একটা অপ্রিয় মুখের সাথে পেয়েছি এত্তগুলো প্রিয়মুখ। তাদের সাথে কাজ করতে গিয়েই নীরস দায়িত্বগুলো সরসভাবে পালন করে যেতে পারছি। এখানে তাঁদের আন্তরিকতার বিষয়টিও স্বীকার্য্য। সবার মাঝে এই আন্তরিকতা থাকে না।
অবশ্য প্রতিষ্ঠান এই আন্তরিকতার কোনোরূপ মূল্য কখনও কাউকে দেয়নি, ভবিষ্যতেও দেবে না। প্রতিষ্ঠান থেকে বিনিময় পাওয়ার আশাটুকু তাই বহু আগেই মাথা থেকে ঝেঁটে বিদেয় করেছি। প্রাণের সহকর্মীগুলোর জন্যেই তাই নিজের মাঝ থেকে একরাশ আন্তরিকতা, সহমর্মিতাগুলো একটানে বের করে আনি। এবং সেখানেও তাদের কাছ থেকে বাহ্যিক কাঠামোগত কোনো বিনিময়ের আশা রাখি না। তাঁরা যেন আমায় তাঁদের আড্ডায় ও দু'আয় স্মরণ করেন -এই বিনিময়টুকু ছাড়া।

যে সহকর্মীদের জন্যে মনের মাঝে এমন শ্রদ্ধাপূর্ণ ভালোবাসা জমিয়ে রেখে কাজ করে যাই, তাদের মধ্যে অল্প ক'জন যখন এর কোনোরূপ মূল্যায়ন করেন না, তখন মনটা তাদের সংকীর্ণ মনের মতই সংকীর্ণতায় আটকে যায়। সংকীর্ণতায় পার্থক্য হচ্ছে, আমি সংকীর্ণ হলাম ভালোবাসা না পেয়ে, আর তারা সংকীর্ণ হলো নিজেদেরই তৈরি স্বার্থপরতার অদ্ভুত বোঝার চাপে। 
কেঁদেছিলামও। কষ্টের কান্না। এমন হৃদয়হীন মানুষও আছে জগতে? অপরিপক্ব মননের সেই মনটা তখন বুঝতে শিখেছিল মাত্র, চিনতে শুরু করেছিল মাত্র।
ঠিক তখনই কয়েকটি অদৃশ্য হাত মাথার উপরে বুলিয়ে গিয়েছিল। সেই বুলিয়ে যাওয়ার গর্ভে ছিল উপদেশ, সান্ত্বনা, এবং স্নেহসুলভ বকা। প্রাণ ফিরে পেয়েছিলাম যেন। ঠিক যেন খরাপ্রবণ জমিতে ঝরে পড়া প্রাণশক্তিময়  বৃষ্টিধারা।
তাঁদের কাছ থেকে নিয়েছিলাম দীক্ষা। তাঁরাও ভাগ করেছিল তাঁদের জীবনের নানা পরতে ঘটে যাওয়া নানান ঘটনাপ্রবাহের হাতুড়িসম আঘাতের সেই স্মৃতিকথাগুলো। খুব বেশি আবেগপ্রবণ নই বলে চোখের পানি ঝরে ঝরে পড়েনি। তবে হৃদয়ে জমে গিয়েছিল জমাটবদ্ধ গ্লানি। নিজের দুঃখকে তখন জলাশয়ে ভেসে যাওয়া খড়কুটোর মতই তুচ্ছ ও মূল্যহীন বলে মনে হতে লাগলো। অথচ সেই আবর্জনার দিকেই অযথা চেয়ে থেকে অজস্র মূল্যবান মুহূর্তকে ভেসে যেতে দিয়েছি।
তাঁদের কাছ থেকে নিয়েছিলাম দীক্ষা। তাঁরাও ভাগ করেছিল তাঁদের জীবনের নানা পরতে ঘটে যাওয়া নানান ঘটনাপ্রবাহের হাতুড়িসম আঘাতের সেই স্মৃতিকথাগুলো। খুব বেশি আবেগপ্রবণ নই বলে চোখের পানি ঝরে ঝরে পড়েনি। তবে হৃদয়ে জমে গিয়েছিল জমাটবদ্ধ গ্লানি। নিজের দুঃখকে তখন জলাশয়ে ভেসে যাওয়া খড়কুটোর মতই তুচ্ছ ও মূল্যহীন বলে মনে হতে লাগলো। অথচ সেই আবর্জনার দিকেই অযথা চেয়ে থেকে অজস্র মূল্যবান মুহূর্তকে ভেসে যেতে দিয়েছি।
কাজের চাপ তো আছেই প্রতিষ্ঠানে। সেখানে যতদিন থাকা হবে, সেই চাপের নিচেই চেপে থাকতে হবে। একটা সময়ে হয়ত প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করা হবে। প্রতিষ্ঠান-প্রধানের জন্যে কোনো কষ্টই হবে না। কষ্ট হবে চারপাশে ছড়িয়ে থাকা নিবেদিতপ্রাণ সহকর্মীদের জন্যে। কষ্ট হবে তাঁদের জন্যে, যাঁরা নিজের হৃদয়টা বের করে আনতে চেয়েছিলেন। কষ্ট হবে তাঁদের জন্যে, যাঁরা কষ্ট স্বীকার করতে শিখিয়েছিলেন। কষ্ট হবে তাঁদের জন্যে, যাঁরা দুঃসময়ে আর কিছু না হোক, একপ্রস্ত রুমাল এগিয়ে দিয়েছিলেন।
ব্যস, আর কোনোকিছুই আমাকে এতটা কষ্ট দেবে না। এসবের ও এসকল মানুষের জন্যেই অন্য ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত এই আস্তাকুঁড়ে পড়ে থাকা। মুহূর্তগুলো পরবর্তীতে অনুপ্রেরণা যোগাবেই, যেখানেই যাই না কেন।
এবং অবশেষে লেখার তরী তীরেই ভিড়ল। হাঁফও ছাড়া হলো। 
- ২৩শে জুলাই, ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দ; রবিবার।
Post a Comment