একটু দ্রুত পা ফেললে দ্রুত পৌঁছে যাওয়া যায়। মাথায় বৃষ্টির ভেজা অনুভবটুকু আর নেয়া লাগে না। আবহাওয়াটুকু অস্থির হয়ে আছে। সম্ভবত মানুষের মতই সেটি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে যে রৌদ্রময় থাকবে, নাকি বৃষ্টিতে ভাসিয়ে দিবে চারদিক। তাই কখনও রোদ, কখনও মেঘ, কখনও বৃষ্টি; এভাবেই কেটে যাচ্ছে ঘণ্টা, মিনিট, সেকেন্ডগুলো।

চোখে এঁটে রাখা রোদচশমাটুকু ভিজে গেল, সেটি খুলে ফেললাম। হাতেই রাখলাম। পলিএস্টারের শার্টটাও এরই মাঝে ভিজে গিয়েছে। পানিটুকু যদি অ্যাবসর্ভ করে নিত, তবে একটু স্বস্তিবোধ হত। সেটি হচ্ছে না। 
রাস্তা পেরিয়ে গলির মুখে ঢুকে পড়লাম। বৃষ্টির স্পর্শ থেকে নিজেকে বাঁচাতে দোকানপাটের শেডের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর অদ্ভুত কিংবা হাস্যদৃষ্টি উপেক্ষা করে এগিয়ে যাচ্ছি বিব্রত হয়ে। 

দুপুরবেলার খাওয়া সেরে আমি একটা অকারণ ভাতঘুম দেই। দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত সময়টা কাটে ঘুমের রাজ্যে। তাতে পিতার কটাক্ষদৃষ্টি, মায়ের টিপ্পনী আমার উপরে বর্ষেই যায়। আজকের দুপুরবেলার ভোজন সেরে নেয়ার মাঝেই ভাবলাম, আজ এই কটাক্ষদৃষ্টি আর টিপ্পনীর বৃষ্টিতে না ভিজলে কেমন হয়। তাই ধোয়া পলিএস্টারের শার্ট পরে নিলাম। বাহিরে তখন চড়া রোদ ছিল, তাই প্রিয় রোদচশমাটুকু চোখে পুরে নিলাম। গন্তব্য, পাঠাগার। একটি পাঠাগারে মোটামুটি আসা-যাওয়া হত, এর সাথে এখন আরেকটি পাঠাগার জুড়ে গেল। সেটাতেই যত আন্তরিক আসা-যাওয়া।

ঘরের আপনজনের সমালোচনার বৃষ্টি থেকে বাঁচলেও কে জানত যে ঘণ্টাখানেক বাদে স্রষ্টার বিশাল আকাশের জমাটবদ্ধ মেঘের বৃষ্টি থেকে আমার একেবারেই রেহাই ছিল না।
বিপত্তিটা ঘটলো, যখন টেম্পো থেকে জামাল খাঁন মোড়ে নামলাম। জামাল খাঁন মোড় থেকে অল্প দূরত্বেই আমার গন্তব্যস্থান, সব মিলিয়ে সাতটা মিনিটের হাঁটাপথ। এবং এরই মাঝে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি ঝুম বৃষ্টিতে পরিণত হলো। আমাকে ভিজিয়ে দিল। খাস্তগির গার্লস স্কুলে তখন সবে ছুটি হয়েছে। তারা দাঁড়িয়ে আছে নিরাপদ স্থানে, যেখানে বৃষ্টির ছাঁট পৌঁছায় না। আমি চোখে রোদচশমা নিয়ে এগোতে থাকলাম। যখন চোখে রোদচশমা পরি, তখন নিজেকে একটু বেশ রকম আলাদা বলে মনে হয়। এটা বোধহয় সুপ্ত অহংকার। তবে সেই পরিবেশে রোদচশমাটুকু বেশ বেমানান ছিল। তবুও সং সেজে এগোতে লাগলাম।

- আসবো মখছুছ ভাই?
যাঁকে ডাকলাম, মখছুছু চৌধুরী, তিনি তখন একটি বইয়ে নিমগ্ন ছিলেন। আমার দিকে চোখাচোখি হতেই তাঁর মুখে এক ক্লান্তিমাখা হাসি ফুটে ওঠলো। হাসির আদানপ্রদান শেষে আমি চট করে লাইব্রেরির দেয়ালঘড়ির দিকে তাকালাম। সময়টাই ক্লান্তিমাখা। দুপুরের শেষ প্রহর। 
আমি জুতো খুলে ঢুকে পড়ে কৈফিয়তের সুরে বললাম, "বৃষ্টি পেয়ে গেল হঠাৎ। অনেকটাই ভিজে গেলাম।"

দু'টুকরো টিস্যু পেপার এগিয়ে দিলেন তিনি। ভেজামুখটুকু মুছে নিয়ে একপাশে বসেই পড়লাম। যেন বহুদিনের চেনা জায়গা, যেন আমার জন্যেই নির্ধারিত বসে পড়া স্থান -এমন আকুলতা নিয়েই হাত-পা ছড়িয়ে মাটিতেই বসে পড়লাম। চোখ চলে গেল আল মাহমুদ রচিত গল্পসমগ্রের দিকে। 

লাইব্রেরি যেমন হয়, এটিও তেমনই। শুধু প্রবেশপথের পূর্বপাশটুকু উন্মুক্ত রেখে উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ দেয়ালে সেঁটে থাকা শেলফে হাজারো বইপত্র সাজানো। রাশি রাশি বই, রাশি রাশি জ্ঞান, রাশি রাশি লেখকের রাশি রাশি অভিজ্ঞতা, অনুভূতি ও দর্শন। প্রতিটা লেখক যেন ঝাঁপি খুলে বসে আছেন। ডাকছেন খদ্দেরদের, মানে পাঠকদের। যেন তারা খুলে খুলে পড়ে নেয় তাদের কথাগুলো। যেন তারাও ঘুরে আসে তাদের শব্দের রাজ্যে, ডুবে যায় সেই কল্পনার সাগরে।

 পাঠক আসেন, চারদিক চোখ বুলিয়ে যান, হাত চলে যায় বিভিন্ন বইয়ের ওপর, স্পর্শ বুলানো হয় বইয়ের প্রতি পাতার উপর। 
আছে টুল, মই। যে বইগুলো নাগালের বাইরে, তার নাগাল পেতেই এই ব্যবস্থা। নাগালের বাইরের বইগুলো তাই বহুদিন ধরে স্পর্শ পায়নি বলে স্বল্প ধুলোয় অল্প ধুসরিত হয়ে পড়েছে। 

'পানকৌড়ির রক্ত' গল্পটি যখন পড়ে যাচ্ছিলাম, যখন ডুবে যাচ্ছিলাম আল মাহমুদের শব্দগত ব্যবহারের মুন্সিয়ানায়, যখন অবাক হয়ে ভাবছিলাম যে কেন এই গল্প আগে পড়া হয়ে ওঠল না; ঠিক তখনই মখছুছ ভাই জিজ্ঞাসা করে বসলেন, "নতুন কিছু লিখছেন না?"

Fountain Pen, Note, Notebook, Page, Paper, Pen

আমি বই থেকে মুখ তুলে সেই মুখে প্রশ্ন ফুটিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তদৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। আমার বিভ্রান্তির নেপথ্য কারণ আছে। আমি লিখি, সেটা সত্যি। তবে তা প্রকৃত লেখকপাড়ায় কখনও তুলে ধরিনি। সাহস, আত্মবিশ্বাস এসবের অভাব আছে প্রকটভাবে। আমার পুরনো লেখাগুলো মখছুছ ভাই পড়েছেন বলে মনে হয় না। সেখানে 'নতুন কিছু' লিখছি কি না, এ প্রশ্নে জিজ্ঞাসিত হলে বিভ্রান্ত হওয়াটাই জায়েজ। 

আমি হাসলাম, স্মিতহাস্য যাকে বলে।

"মখছুছ ভাই, লিখি কম, ইদানিং তো থেমেই গিয়েছে। মানে থামিয়ে নিয়েছি।"
"কেন? থামালেন কেন হঠাৎ? কেউ বকেছে নাকি আমার মত!?"

মখছুছ ভাই একজন কবি, ছড়াকার ও এর সাথে সাহিত্য-সমালোচক বিধায় তাঁর এই কথাটির অর্থ ধরতে বেগ পেতে হয়নি। 
"আরে না ভাই, আমার লেখার কোনো সমালোচক নেই।"
"কেন, আপনার লেখাগুলোয় কোনো ভুল থাকে না?"
"না, আমি সেটা বুঝাইনি। বরং বুঝিয়েছি যে আমার লেখাগুলোকে সমালোচনার দৃষ্টি নিয়ে কেউ পড়বে, এমন মানুষ কম। তাছাড়া আমি লিখি কম। তাই সমালোচনা আসবে কোথা থেকে।"

মখছুছ ভাই নিজের হাতের বইটা ভাঁজ করে সেটির মাঝে একটি আঙ্গুল চাপিয়ে রেখে বন্ধ করে নিলেন। এরপর বললেন,
"সমালোচিত হয়েছেন কখনও?"

আমার মনে পড়ে গেল, আমারই লেখা এক গল্পের তিতকুটে সমালোচনা করেছিলেন এক সুহৃদ। সেই সমালোচনার তিতকুটে স্বাদটুকু জিভে অনুভব করলাম যেন। তবুও মখছুছ ভাইয়ের সামনে সেই স্বাদের প্রতিক্রিয়া ফুটিয়ে তুললাম না। 
"না মখছুছ ভাই, ওভাবে হইনি।"
"বেশ। সমালোচনার কিন্তু বেশ প্রয়োজন আছে। সমালোচনা একটি মানুষকে শুদ্ধ করে। সমালোচনাই তো মানুষকে বুঝিয়ে দেয় যে তার ঠিক কোন অংশের সংশোধন প্রয়োজন।"

আমি নড়েচড়ে বসলাম। কারণ মখছুছ ভাইয়ের কথাগুলো আমাকে বেশ প্রভাবিত করছে। ব্যক্তিগতভাবে আমিও সমালোচনার পক্ষে। শুধু লেখার বেলায়ই নয়, বরং চরিত্রগত এবং কর্মগত দিক দিয়েও সমালোচনার বেশ গুরুত্ব আছে, তা আমি বিশ্বাস করি দৃঢ়ভাবেই। 

মখছুছ ভাই বলে চললেন,
"সমালোচনা নিয়ে একপ্রস্থ লেকচার কিন্তু দেয়া যায়। তবে সমস্যাটা হচ্ছে বাঙালি জাতি সমালোচনা সহ্য করতে পারে না।"
আমি মাথা নেড়ে বললাম,
"সত্য বলেছেন মখছুছ ভাই।"
"আপনি এই গরমে পলিএস্টারের শার্ট গায়ে কেন দিলেন? আপনি কি বেকুব?"

আমি বাইরে তাকালাম, ততক্ষণে চড়চড়িয়ে রোদ ওঠে গেছে। আমি ভিজে গিয়েছিলাম, তবে বেরোবার সময় তো চড়া রোদ ছিল। আমি সজ্ঞানেই এই শার্ট পরেছিলাম। কারণ সাধারণত সুতির যে কাপড়গুলো পরে বের হই, তা ধুয়ে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছিল রোদের নিচে এবং সেগুলো তখনও শুকোয়নি। নিরুপায় হয়েই এই পলিএস্টারের শার্টের মাঝে নিজের উর্ধাঙ্গকে  প্রবেশ করাতে বাধ্য হই।

"না মখছুছ ভাই। বেকুব কি না জানি না, তবে অনেকটা নিরুপায় হয়েই এ কাজটা করলাম। সব সুতির কাপড় ধুয়ে ফেলেছে তো, বেরোবার সময়ও সেগুলো শুকোয়নি।"
মখছুছ ভাই আমার হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন,
"আপনি দেখছি কিছুই মনে করেননি। আপনাকে 'বেকুব' বলেছি, এতে কষ্ট পাননি?"
"আরে কী যে বলেন, কষ্ট কেন পাব? আপনি তো মজা করে বলেছেন।"
"মজা করে বলিনি। গুরুত্বের সাথেই বলেছি।"

আমি একটু ভেবে বললাম,
"গুরুত্বের সাথে বললেও এখানে মনে করার কিছু নেই আসলে। একমাত্র বেকুবারেই গরমে পলিএস্টার পরে ঘুরে বেড়ায়, আর শীতে কম পোশাক পরে ক্যামেরার সামনে দেহ দেখিয়ে বেড়ায়।"

মখছুছ ভাই হেসে ফেললেন। হাসতে হাসতেই বললেন,
"এই যে আপনি এখন যে ঝালবাক্য ঝেড়েছেন, এটাও কিন্তু সমালোচনা। যাকে উদ্দেশ্য করে ঝেড়েছেন, মানে যে নায়িকাকে উদ্দেশ্য করেছেন, তিনি এটা শুনলে কিন্তু মাইন্ড করতেন। "
আমি হাসলাম। বললাম, 
"যাহোক, আমি কষ্ট পাইনি। কষ্ট পাইও না। সে কারণেই সমালোচিত হতে চাই।"

বিকেলটা ঘনিয়ে আসলে মখছুছ ভাই আমাকে নাশতা করাতে নিয়ে গেলেন একটি রেস্তোঁরায়। তিনি ছোলাবুট, পেঁয়াজু, বেগুনী খেলেও আমাকে খেতে হলো ফ্রুট-কাস্টার্ড। ইদানিং ভাজাপোড়া আমার পেটে সয়ে গেলেও ত্বকে সয় না। একজিমা ছড়িয়ে পড়েছিল সারা দেহে, এমনকি মুখেও। এখন পথ্য চলছে। মশলাজাতীয় খাবারগুলো নিজের জন্যে তাই নিষিদ্ধ করে নিলাম।

"কবিতা লেখা হয় তানসীর ভাই?"
আমি ফ্রুট কাস্টার্ড হতে এক চামচ মুখে পুরে ফেলেছিলাম। এই প্রশ্ন শুনে মখছুছ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। উত্তরটা কিন্তু ইতিবাচকতায় মোড়া হবে। কবিতা তো মাঝেমাঝেই লিখি। বললাম, "না, কবিতা লেখা হয় না।"

এবং নিজের উত্তর নিজের কানে যেতেই খুব অবাক হলাম। কেন এই মিথ্যেটুকু বললাম বা কেন কবিতা লেখার বিষয়টি স্বীকারে আনলাম না, তা বুঝতে পারলাম না।

আমার চরিত্রের বহু অদ্ভুত দিক সম্পর্কে আমার পরিচিতজনেরা জ্ঞাত আছেন। এসব খুব অল্পদিন আগ থেকে আমার মাঝে ফুটে ওঠছে। আমি মাঝেমাঝে কোনো কারণ ছাড়াই গা ঢাকা দিই, আবার কোনো কারণ ছাড়াই কাউকে ফোন দিয়ে বসি। এর মাঝে আরো আছে যে আমি কোনো কারণ ছাড়াই মাঝেমাঝে (মিথ্যা না বললেও) ব্যক্তিগত তথ্যগত দিক থেকে কোনো সত্যকে আড়াল করি। তবে তথ্যগুলো তুচ্ছ ধরনের তথ্য হয়। যেমন, আমার দেরীতে ঘুম থেকে জাগা, সমুদ্র পছন্দ করা, বন্ধুদের সাথে ঘুরতে পছন্দ করা, লেখকদের সান্নিধ্যে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থাকা, গান গাইতে পারা কিংবা কবিতা লিখতে পারা; এসব ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হলে আমি সবসময় না হলেও মাঝেমাঝে সত্য জবাবটুকু দিই না। কী জানি এর কোনো সাইকোলজিক্যাল এক্সপ্লেনেশন আছে কি না। থাকতেও পারে।

আমার উত্তর শুনে মখছুছ ভাই শুধু মাথা নাড়ালেন, আর কিছু বললেন না। আমিও কাস্টার্ডে মনোযোগী হলাম।

লাইব্রেরিতে ফিরে এসেই আবার বসে পড়লাম একটি বই হাতে। মখছুছ ভাইয়ের এই লাইব্রেরিতে এর আগে বারকয়েক আসা হয়েছিল। এসেই আমি বই পড়তে বসে যাই।আলাপ যে হয় না, তা নয়। তবে বইয়ের পাতাতে একবার ডুবে গেলে আর কোনো প্রসঙ্গ আমাকে ওভাবে টানতে চায় না। 

তবে মন খারাপ লাগে এই ভেবে যে, এখানে আমাকে একাকী আসতে হচ্ছে। তখনই মখছুছ ভাইয়ের দিকে লক্ষ্য করি, তিনিও তো সারাটা সপ্তাহ এই লাইব্রেরিতে একাই কাটিয়ে দেন। শুধু সপ্তাহের একটা ছুটির দিনেই কিছু কবি-সাহিত্যিক আর কিছু পরিচিত মুখ এখানে এসে ভীড় জমান। লাইব্রেরি তিনি খুলেছেন ব্যবসায়ের জন্যে নয়, বরং পাঠকদের সমাবেশের জন্যে। যদিও মেম্বারশিপের ব্যবস্থা আজও করা হয়নি। তবুও কেউ এলে তিনি চান যেন সেই পাঠক বই পড়ার পাশাপাশি তার সাথেও কিছু গল্প করুক।

আগেই বলেছি মখছুছ ভাই একজন কবি ও ছড়াকার। তবুও তিনি বেশ চমৎকার একজন মানুষ। বেশ পরিপাটি থাকেন, খুবই সাদামাটা বেশভূষায় চলাফেরা করেন। অথচ তাঁকে দেখে বুঝার উপায় নেই যে তিনি একটা সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক ছিলেন। বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি প্রভাষণার দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া কয়েকটি ব্যবসায়ে তাঁর কিছু অংশীদারিত্বও আছে বিধায় আয়ের দিক থেকে ওভাবে তাঁকে ভাবতে হয় না। সেখানে অন্যেরা দায়িত্বে আছেন বলে তাঁকে সময় দিতে হয় না। তাছাড়া তিনি সাহিত্যের মানুষ, তাই বইপত্র নিয়ে থাকতেই তিনি ভালোবাসেন। 

বয়সটা ত্রিশের কাছাকাছি, এখনও বিবাহ করেননি। এইটুকু নিয়ে যা আফসোস। তাগিদের অভাব হচ্ছে না। তিনিও কম চেষ্টা করছেন না। পাচ্ছেন অনেক পাত্রী। তবে তাঁরা ভাইয়ার মনমত হচ্ছে না। যদিও এসব বিষয় নিয়ে সরাসরি আমার সাথে তাঁর আলাপ হয়নি। অন্যদের মাধ্যমে জেনেছি বিষয়গুলো।

"রাইটার্স ব্লক সম্বন্ধে ধারণা আছে আপনার?" -প্রশ্নটা আমাকে করা হলো। আমি বই থেকে নজর ফিরিয়ে বললাম,
"হ্যাঁ, আছে কিছুটা। বড় বড় লেখকেরা এই সমস্যায় মাঝেমাঝে ভুগেন। অনেকের তো বছরের পর বছর এই সমস্যার মাঝ দিয়েও যাওয়া লাগে।"
"হ্যাঁ, এটার সংজ্ঞাটা বলেন তো দেখি।"

আমি একটু ভাবার জন্যে সময় নিলাম, এরপরে বলে চললাম,
"লেখকেরা যখন নতুন চিন্তাসম্বলিত বা অভিজ্ঞতাসম্বলিত কোনো সৃষ্টিকর্ম তৈরি করতে গিয়ে একটি বাধার সম্মুখীন হন, ঠিক সেই বাধাসংক্রান্ত সমস্যাটিকেই রাইটার্স ব্লক বলা হয়।"

মখছুছ ভাই হেসে ফেললেন,
"বাপরে বাপ, পুরো মুখস্থ ছিল নাকি?"
আমি লজ্জার হাসি হেসে বললাম,
"আরে না, কী যে বলেন! আমি ভাবার সময় নিলাম কেন বুঝেননি? মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছিলাম।"
"আচ্ছা বেশ। তাহলে এটা নিয়ে কিছু বলা যাক। আসলে একাকী থাকলে চুপচাপ থাকতে পারি। কিন্তু পাশে কেউ থাকলে একটু লেকচার দিতে ইচ্ছে করে। একসময় লেকচারার ছিলাম কি না, তাই আর কি। হাহা। 
যাহোক, এখন বলি। এই রাইটার্স ব্লক সমস্যাটা নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা শুরু হয়েছে কিন্তু সত্তর আর আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে। মানে তখন থেকেই এটি অধিক আলোচিত একটি সমস্যা। যদিও সাইকোএনালিস্ট এডমন্ড বার্গলার এটি নিয়ে সর্বপ্রথম আলোচনা করেছিলেন ১৯৪৭ সালে। তবে তাঁর আলোচনার আগেও এই সমস্যাটি অল্প কয়েকজন সাহিত্যিকদের মাঝে দেখা গিয়েছিল।"

আমি হাতের বইটা পুরোপুরি বন্ধ করে মখছুছ ভাইয়ের দিকে ঘুরে গেলাম। তিনি তখনও বলে চলেছেন,
"রাইটার্স ব্লকের অনেকগুলো কারণ কিন্তু গবেষকেরা বের করেছেন। এর মধ্যে দেখা গেছে লেখকের যথাযথ অনুপ্রেরণা না পাওয়া বা যাদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেলে তার লেখনী আরো গতি পেত, তাদের কাছ থেকে না পাওয়া। এছাড়া প্রেমে ব্যর্থ, বিবাহ-বিচ্ছেদ, পরিবারের সদস্যদের সাথে মনোমালিন্য কিংবা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া, পড়াশোনায় ব্যর্থতা, চাকরি না পাওয়া কিংবা ব্যবসায়ে উপর্যুপরি লোকসানের মুখ দেখা; এসব কারণে লেখকের জীবনে রাইটার্স ব্লকের সমস্যা বড় আকারে দেখা যায়। 

আবার অনেক সময় একজন লেখক, সে কবি হোক বা গল্পকার, সে যা লিখবে সেটির প্লটের বিশালতার কারণেও এই ব্লকটা চলে আসতে পারে। এর উদাহরণ দেয়া যায় ঔপন্যাসিক জর্জ অরওয়েলের একটি উপন্যাস "কিপ দ্য এসপিডিস্ট্রা ফ্লাইং" এর একটি ঘটনা থেকে। সেখানে একজন কবি লন্ডনের একটি ব্যস্তময় দিনের বর্ণনা সম্বলিত একটি মহাকাব্য লিখতে শুরু করলেও তার অনেকটা পথ পেরিয়ে এসে সে দেখল, সে আর লিখতে পারছে না। আটকে যাচ্ছে।
এখন বিষয়টা হচ্ছে এমন, রাইটার্স ব্লককে অনেকেই একটি সাধারণ মানসিকতার সাথে তুলনা করে বসে। অনেকের মতে, রাইটার্স ব্লক সবারই হয়।  

যেমন আমার পরিচিত এক লেখকের সাথে কথা হচ্ছিল ক'দিন আগে। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, লেখালেখি চলছে কেমন? তিনি নির্বিকারভাবেই জবাব দিলেন যে তিনি রাইটার্স ব্লকে আছেন। যেহেতু রাইটার্স ব্লকের ভয়াবহতা সম্পর্কে আমার ধারণা আছে, তাই আমি আঁতকে ওঠলাম। তাঁকে তাঁর সমস্যাটির ব্যাপারে আরেকটু বিস্তারিত জিজ্ঞাসা করলাম। তখন তিনি বললেন, তিনি লেখালেখির মাঝে আর আনন্দ পান না। তাই লিখেন না। এই কথা শুনে আমি হাঁফ ছাড়লাম। এবং সাথে এটিও বুঝলাম সেই গল্পকার জানেনই না যে রাইটার্স ব্লক প্রকৃত অর্থে কী বস্তু। 

রাইটার্স ব্লকের ব্যাপারে মানুষের ভুল ধারণাটা এখানেই। লিখতে ইচ্ছে না করলে সেটা রাইটার্স ব্লকের আওতায় পড়ে না। বরং লিখতে প্রবল ইচ্ছে হচ্ছে, তবে কলম নিয়ে বা কি-বোর্ড নিয়ে লিখতে বসেছেন, এবং একটি শব্দও মাথায় আনতে পারছেন না, এবং তাতেই আপনি এক পাহাড়সম কষ্টবোধে ভুগছেন; মূলত এটাই হলো রাইটার্স ব্লক।

আমাদের দেশে না হলেও বিদেশি অনেক সাহিত্যিক এই সমস্যার কারণে সুইসাইড পর্যন্ত করে ফেলেছেন। অনেকেই আর্নেস্ট হেমিংওয়ের আত্মহত্যার পেছনে এই রাইটার্স ব্লককেই দায়ী বলে মনে করেন। আর্নেস্ট হেমিংওয়েকে চিনেছেন তো, ওই যে বিশ্বনন্দিত উপন্যাস 'Old Man & The Sea' -এর লেখক। 

আসলে রাইটার্স ব্লকের যে যে কারণগুলো বললাম, সেগুলোর সবই মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা। এসব সমস্যা মস্তিষ্কের উপরে বিরূপ প্রভাব ফেলে। আর লেখালেখির সমস্তটাই তো মস্তিষ্কের উপর। মস্তিষ্কের একটা অংশ তখন আরেকটা অংশকে কো-অপারেট করে না। সেগুলো অনেকটা যেন থেমে যায়। তাই গল্পের প্লটও মাথায় আসে না। সাথে আসে না অনুচ্ছেদ বর্ণনার কোনো নতুন ধারণাও। 

বড় বড় সাহিত্যিকেরা বাদেও অনেক ক্ষেত্রে ক্ষুদে সাহিত্যিকেরাও এসব সমস্যায় পড়ে যান। তারাও কবিতা, গল্প আর লিখতেই পারেন না। আমাদের দেশে কবিদের এই সমস্যাটি বেশি হয়। কারণ কবিমাত্রই প্রেমিকপুরুষ। এবং হাল আমলে প্রেম হলো ফ্রাস্ট্রেটধর্মী। যদিও প্রেমে ব্যর্থতার পর তারা কবিতা লেখেন। তবুও একটা সময়ে গিয়ে তাতেও বাধা পড়ে। 

তবে শেষ আরেকটি সমস্যা হলো অত্যাধিক সমালোচনা। অখণ্ড প্রশংসা যেমন লেখকের সৃষ্টিশীলতার অন্তরায়, ঠিক তেমনি মাত্রাতিরিক্ত সমালোচনাও তার সৃষ্টিশীলতার অন্তরায়। খুব বেশি ক্রিটিসিজমের শিকার হলে লেখকেরা আশাহত হয়ে পড়েন। এবং আক্রান্ত হন রাইটার্স ব্লকে। তবে এইদিকটা শুধুমাত্র প্রযোজ্য হবে বাঘা সাহিত্যিকদের বেলায়। যারা লেখালেখি সবে শিখছে, তারা সমালোচনা সহ্য করতে না পারলে তারা প্রকৃত সাহিত্যিক হয়ে ওঠবে না।"

আমি টেম্পোতে বসে আছি। বাহিরে এখন রাত নেমে গেছে। রাজপথ অবশ্য বেশ আলোকিত। যানবাহন, স্ট্রিট ল্যাম্প, এবং সড়কের পাশের শপিং মলগুলোর চোখ ধাঁধানো আলো চারপাশকে আলোকিত করে রেখেছে। 

একপশলা বৃষ্টি সেই দুপুরের শেষ প্রহরেই হয়েছিল, এরপরে রোদ চড়ে যায়, এবং সন্ধ্যা নেমে রাত ঘনিয়ে এলেও পরিবেশের গুমোটতা এখনও ছেয়ে আছে। আমি পলিএস্টারের শার্টের ভেতরে ঘেমে যাচ্ছি। 

রাইটার্স ব্লকের বিষয়টা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। মখছুছ ভাই যখন এটি নিয়ে বলেই যাচ্ছিলেন, তখন নিজের মাঝেই একটা অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিলাম।

আমার তখনই মনে পড়লো আমার বেশ কয়েকজন প্রিয়মুখ আমার নতুন গল্পের আশায় অপেক্ষমাণ।
আমার তখনই মনে পড়লো আমি কেন নতুন কিছু লিখছি না, সে ব্যাপারে তাঁরা আমার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন।
আমার তখনই মনে পড়লো আমার স্বভাবের সেই অদ্ভুত দিকটির কথা।
প্রকৃত সত্যটুকু আড়ালের প্রবণতা ও তুচ্ছ কিছু তথ্য আড়ালের কথা। 
নিজেকে রাইটার্স ব্লকে আক্রান্ত রোগী বলে মনে হলো। কষ্ট হলো। আমার সমালোচনাতেও আমি এত কষ্ট পেয়েছি বলে আমার মনে পড়লো না। 

Post a Comment

Previous Post Next Post